ভারতে লোকসভা ভোট আজ শুরু ॥ সাত ধাপে নির্বাচন ॥ ২৩ মে ফল ঘোষণা

36

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন আজ বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে। ১১ এপ্রিল শুরু হয়ে ৭ ধাপে এ নির্বাচন চলবে আগামী ১৯ মে পর্যন্ত। ফল ঘোষণা করা হবে ২৩ মে। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করবে। এদিকে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে কয়েকটি প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচনও হচ্ছে। বিধানসভার নির্বাচন হবে অন্ধ্রপ্রদেশ, সিকিম, অরুণাচল ও উড়িষ্যায়। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে এবার ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। এর মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা ৪৩ কোটি ২০ লাখ। সর্বশেষ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ছিল ৮৩ কোটি। তবে সেবার মোট ভোটারের ৬৬ শতাংশ বা ৫৫ কোটি ৩০ লাখ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। ওই নির্বাচনে ৪৬৪ রাজনৈতিক দলের ৮ হাজার ২৫১ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
ভারতের স্বাধীনতার পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ৬৬.৪ শতাংশ ভোট পড়ে। এর মানে বিপুলসংখ্যক ভোটার ভোট দেননি। হিসাব করলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ২৭ কোটি ৩০ লাখ। ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ লোকের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। প্রায় ৪৩ কোটি মানুষের স্মার্টফোন রয়েছে, প্রায় ৫০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, ৩০ কোটি ফেসবুক ব্যবহার করেন। আর ২০
কোটি হোয়াটসএ্যাপে বার্তা পাঠান এবং তিন কোটি মানুষ টুইটার ব্যবহার করেন। তাই নতুন ভোটারদের হৃদয় জয় করতে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা নতুন নতুন প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন। নির্বাচনের আচরণবিধি প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছরের লোকসভা নির্বাচনে প্রায় দুই হাজার রাজনৈতিক দল এবং আট হাজারের বেশি প্রার্থী ৫৪৩ আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নির্বাচন উপলক্ষে লাখ লাখ নির্বাচনী কর্মী, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে বড় বড় শহর ও গ্রামে মোতায়েন করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভোট নিতে বিমান, নৌকা, ট্রেন, হেলিকপ্টার, হাতি, ঘোড়া এবং হেঁটে নির্বাচনী কেন্দ্রে যান তারা। সব মিলিয়ে ভারতে নির্বাচন যেন একটি উৎসব।
কোন ধাপে কখন ভোট : লোকসভার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ধাপে ভোট হবে যথাক্রমে ১১ এপ্রিল, ১৮ এপ্রিল, ২৩ এপ্রিল, ২৯ এপ্রিল, ৬ মে, ১২ মে এবং ১৯ মে। সব ধাপের ভোট গ্রহণের পর গণনা হবে ২৩ মে, সেদিনই গণনার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষিত হতে থাকবে ফলাফল।
প্রথম ধাপে ভোট যে রাজ্য-অঞ্চলে (আসন সংখ্যাসহ) : প্রথম ধাপে ভোট হবে ২০টি রাজ্য-অঞ্চলের ৯১টি আসনে। এর মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের ২৫টি, অরুণাচল প্রদেশের ২, অসমের ৫, বিহারের ৪, ছত্তিশগড়ের ১, কাশ্মীরের ২, মহারাষ্ট্রের ৭, মনিপুরের ১, মেঘালয়ের ২, মিজোরামের ১, নাগাল্যান্ডের ১, উড়িষ্যার ৪, সিকিমের ১, তেলেঙ্গানার ১৭, ত্রিপুরার ১, উত্তরপ্রদেশের ৮, উত্তরাখ-ের ৫, পশ্চিমবঙ্গের ২, আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপের ১ ও লাক্ষাদ্বীপের ১টি আসন রয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপে ভোট যে রাজ্য-অঞ্চলে (আসন সংখ্যাসহ) : দ্বিতীয় ধাপে ভোট হবে ১৩টি রাজ্য-অঞ্চলের ৯৭ আসনে। এরমধ্যে অসমের ৫, বিহারের ৫, ছত্তিশগড়ের ৩, কাশ্মীরের ২, কর্ণাটকের ১৪, মহারাষ্ট্রের ১০, মনিপুরের ১, উড়িষ্যার ৫, তামিলনাড়ুর ৩৯, ত্রিপুরার ১, পশ্চিমবঙ্গের ৩ এবং পুড়ুচেরির ১টি আসন রয়েছে।
তৃতীয় ধাপে ভোট যে রাজ্য-অঞ্চলে (আসন সংখ্যাসহ) : তৃতীয় ধাপে ভোট হবে ১৪টি রাজ্য-অঞ্চলের ১১৫ আসনে। এরমধ্যে অসমের ৪টি, বিহারের ৫, ছত্তিশগড়ের ৭, গুজরাটের ২৬, গোয়ার ২, কাশ্মীরের ১, কর্ণাটকের ১৪, কেরলে ২০, মহারাষ্ট্রের ১৪, উড়িষ্যার ৬, উত্তরপ্রদেশের ১০, পশ্চিমবঙ্গের ৫, দাদরা ও নগর হাবেলির ১ এবং দামান ও দীউর ১টি আসন রয়েছে।
চতুর্থ ধাপে ভোট যে রাজ্য-অঞ্চলে (আসন সংখ্যাসহ) : চতুর্থ ধাপে ভোটগ্রহণ হবে ৯টি রাজ্য-অঞ্চলের ৭১টি আসনে। এর মধ্যে বিহারের ৫টি, কাশ্মীরের ১, ঝাড়খন্ডের ৩, মধ্যপ্রদেশের ৬, মহারাষ্ট্রের ১৭, উড়িষ্যার ৬, রাজস্থানের ১৩, উত্তরপ্রদেশের ১৩ এবং পশ্চিমবঙ্গের ৮টি আসন রয়েছে।
পঞ্চম ধাপে ভোট যে রাজ্য-অঞ্চলে (আসন সংখ্যাসহ) : পঞ্চম ধাপে ভোট হবে ৭টি রাজ্য-অঞ্চলের ৫১ আসনে। এর মধ্যে বিহারের ৫টি, কাশ্মীরের ২, ঝাড়খন্ডের ৪, মধ্যপ্রদেশের ৭, রাজস্থানের ১২, উত্তরপ্রদেশের ১৪ এবং পশ্চিমবঙ্গের ৭টি আসন রয়েছে।
ষষ্ঠ ধাপে ভোট যে রাজ্য-অঞ্চলে (আসন সংখ্যাসহ) : ষষ্ঠ ধাপে ভোটের লড়াই হবে ৭টি রাজ্য-অঞ্চলের ৫৯ আসনে। এরমধ্যে বিহারের ৮, হরিয়ানার ১০, ঝাড়খন্ডের ৪, মধ্যপ্রদেশের ৮, উত্তরপ্রদেশের ১৪, পশ্চিমবঙ্গের ৮ এবং দিল্লী-এনসিআরের (জাতীয় রাজধানী অঞ্চল) ৭ আসন রয়েছে।
সপ্তম ধাপে ভোট যে রাজ্য-অঞ্চলে (আসন সংখ্যাসহ) : সবশেষ সপ্তম ধাপে ভোট হবে ৮ রাজ্য-অঞ্চলের ৫৯ আসনে। এর মধ্যে বিহারের ৮, ঝাড়খ-ের ৩, মধ্যপ্রদেশের ৮, পাঞ্জাবের ১৩, পশ্চিমবঙ্গের ৯, চন্ডিগড়ের ১, উত্তর প্রদেশের ১৩ এবং হিমাচল প্রদেশের ৪ আসন রয়েছে।
এ বছর দেশটিতে ভোটার কত : প্রায় ১৩২ কোটি জনগোষ্ঠীর ভারতে এবার ভোট দেবেন প্রায় ৯০০ মিলিয়ন বা ৯০ কোটি ভোটার। ভোট কেন্দ্র থাকবে ১০ লাখেরও বেশি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৮১ কোটি ৪৫ লাখ ভোটার। এবার নতুন অর্থাৎ ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সী ভোটার প্রায় দেড় কোটি। ২০১২ সাল থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে আসা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী থেকে এবার ভোটার ৩৮ হাজার ৩২৫।
সরকার গড়তে যত আসন লাগবে : ভারতের সংসদ দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট। এরমধ্যে একটি হলো লোকসভা, এটি নিম্নকক্ষ; আরেকটি রাজ্যসভা, সেটি উচ্চকক্ষ। লোকসভায় মোট আসন ৫৪৫। এর মধ্যে ৫৪৩ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়। বাকি দু’টি আসনে এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্রতিনিধিকে মনোনীত করে আনা হয়। সরকার গঠনের জন্য লোকসভায় ২৭২ আসনের প্রয়োজন। রাজ্যসভার সদস্য সংখ্যা ২৫০। এরা রাজ্য বা অঞ্চলগুলোর বিধানসভার সদস্যদের ভোটে রাজ্যসভায় আসেন।
লোকসভা নির্বাচনের কেন্দ্র : ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য ১০ লাখের বেশি নির্বাচনী কেন্দ্র করা হবে, যা নতুন বিশ্বরেকর্ড। ভোটার ভেরিফায়েবল অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সব কেন্দ্রেই ব্যবহার করা হবে। ব্যবহার করা হবে ১১ লাখ ইলেক্ট্র্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)।
বৈধ ভোটার : নির্বাচন কমিশন জানায়, নির্বাচনে প্রায় ৯০ কোটি বৈধ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। প্রথম লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত ভোটার বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ।
প্রথম ভোটার : এ বছরের লোকসভা নির্বাচনে ১৩ কোটিরও বেশি প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছেন। এসব ভোটারের বয়স ১৮-১৯ বছরের মধ্যে। দুই তৃতীয়াংশ ভারতীয়র বয়স ৩৫ বছরের নিচে।
অন্যান্য ক্যাটাগরির ভোটার : ভোটার তালিকায় হিজরাদের নাম থাকবে ‘অন্যান্য’ ভোটার ক্যাটাগরিতে। এ তালিকায় ভোটার রয়েছেন ৩৮ হাজার ৩২৫।
প্রার্থী : এবারের নির্বাচনে আট হাজারের বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ৫৪৩ আসনের জন্য তারা লড়াই করবেন। দুটি আসন সংরক্ষিত রয়েছে।
রাজনৈতিক দল : নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃত এক হাজার ৮৪১ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
ব্যয় : নয়াদিল্লী ভিত্তিক সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যয় হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি রুপী ব্যয় হবে।
এক নজরে বিগত নির্বাচন : গত ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে নজিরবিহীন জয় পেয়ে সরকার গড়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক এ্যালায়েন্স। ১৯৮৪ সালের পর প্রথমবারের মতো একক দল হিসেবে সরকার গঠনের মতো আসন পেয়ে যায় বিজেপিই। পদ্মফুল ফুটেছিল ২৮২ আসনে। বিজেপি জোটের অন্য দলগুলো পেয়েছিল ৫৫ আসন। অন্যদিকে আগের সরকার চালানো সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পায় মাত্র ৪৪টি আসন। তাদের জোটের দলগুলো পায় ১৫ আসন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস পায় ৩৪ আসন। তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার দল এআইএডিএমকে পায় ৩৭ আসন।
মোদির জীবনীভিত্তিক সিনেমা আটকে দিলো নির্বাচন কমিশন : নির্বাচনের মৌসুমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্রের মুক্তি আটকে দিয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। বুধবার এক নির্দেশেনায় ভারতীয় নির্বাচন কমিশন বলেছে, লোকসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে ‘পিএম নরেন্দ্র মোদি’ সিনেমাটি মুক্তি দেয়া যাবে না। ভারতজুড়ে আলোচিত এই সিনেমাটি ১১ এপ্রিল মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রযোজক।
মোদি ফের নির্বাচিত হলে আলোচনার সুযোগ থাকবেÑ ইমরান : ভারতের নির্বাচন নিয়ে দেশটির অন্যতম প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি জয়ী হলে কাশ্মীর ইস্যুতে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেয়ার ভাল সুযোগ তৈরি হতে পারে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার এলে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।