কাজিরবাজার ডেস্ক :
আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। বিকেলে ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন। ‘অনেক হয়েছে আর নয়, তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। লা-কুম দীনিকুম অলইয়া দীন’র মতো অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও’। তিনি আরও বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোন কিছু না করা হলে আমি মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন শুরু করব। মওলানা ভাসানী এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলেন। আপামর জনসাধারণের দুই নেতা যখন এইভাবে একাত্মতা ঘোষণা করেন, তখন ঘরে ঘরে মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতির সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখতে থাকে। ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। এই কথাগুলো ছিল দূরদর্শী মওলানা ভাসানীর। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই, যখন প্রধান দুই নেতা একসঙ্গে একই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ঐক্যমত প্রকাশ করেন তখন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচী অনুযায়ী সচিবালয়সহ সারাদেশে সকল সরকারী ও আধাসরকারী অফিস, হাইকোর্ট ও জেলাকোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারী অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কেবল সেসব অফিস চালু থাকে। গভীর রাতে ইসলামাবাদে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসক নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ ৭ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। টিক্কা খান ৭ মার্চ ঢাকা আসেন। ৬ মার্চ তাকে পূর্বাঞ্চলের গবর্নর নিয়োগ করা হয়। আজ তার গবর্নর হিসেবে কার্যভার গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতাল চলাকালে ঢাকা হাইকোর্টের কোন বিচারপতি নবনিযুক্ত সামরিক গবর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকার জাতিসংঘের উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দফতর পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’-এর ছাত্র সভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করেন। রাজশাহীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন নৈশ কারফিউ জারির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। সকালে পিআইএ-এর বাঙালি কর্মচারীরা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলে তিনি তাদের সাক্ষাতদান করেন। হরতাল, অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল সমগ্র চট্টগ্রাম। দুপুরের দিকে রেলওয়ে কলোনি ও এ.কে.খান রোডে বাঙালী-বিহারী সংঘর্ষ হয়। বিকেলে হালিশহর হতে দেওয়ান হাট হয়ে আগ্রাবাদ পর্যন্ত বিহারীরা ভারি অস্ত্র নিয়ে শোডাউন দেয়। পাকিস্তান আর্মি বিহারীদের গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করছিল। পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছিল। অন্যদিকে চট্টেশ্বরী রোডে ‘চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ’-এর অফিসে গণসঙ্গীতের মহড়া শুরু হয়।