ফরিদ আহমদ দুলাল
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে পৃথিবীর অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টরি হেরিটেজ’ ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উচ্চারিত হবার ছেচল্লিশ বছর পর। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিষয়টি বাঙালি ১৯৭১-এ এক নদী রক্ত দিয়ে এবং বিজয় অর্জনের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছে। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে কিছু লেখালেখি অবশ্যই হয়েছে, বক্তৃতাও অল্পবিস্তর হয়েছে; কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দী পর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা যখন বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বপ্রেক্ষাপটে অন্যতম প্রভাববিস্তারকারী ঐতিহাসিক ভাষণ বলে স্বীকৃতি দেয়, তখন সচেতন মানুষ মাত্রই একবার নড়েচড়ে বসেন। আমরা আগেই জেনেছি বিশ্বসেরা ভাষণের তালিকায় গৌরবান্বিত হয়েছে মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকনের ভাষণ। যতবার আমরা তাদের ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণকে বিবেচনায় এনেছি, ততবারই মনে হয়েছে, যে কোনো বিবেচনায়ই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পৃথিবীর যে কোন ঐতিহাসিক ভাষণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যমন্ডিতও বটে; কিন্তু যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাদপদ মানুষের একজন বিশ্বপ্রভাববলয়হীন নেতার ভাষণ, এবং যেহেতু সে ভাষণের অনিবার্য ফল হিসেবে বিশ্বের পরাশক্তির ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছে; সঙ্গত কারণেই তাঁর ভাষণকে কেউ বড় ধরনের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যে বিশ্বের প্রভাবশালী ভাষণগুলোর অন্যতম সে কথা বিশ্বের জ্ঞানী-গুণীরা সবাই জানেন; কিন্তু যে জাতি তার স্বপ্ন পূরণকারী নেতাকে এভাবে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে, সেই জাতির নেতাকে বিশ্ব কেন সম্মান জানাবে? ধারণা করি, এই একটি মাত্র কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ওয়াল্ড হেরিটেজের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বিলম্ব হলো। আজ ইতিহাসের অমোঘ সত্যি হিসাবেই ছেচল্লিশ বছর পর সত্যিটা সামনে এসেছে এবং ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভাষণটিকে মর্যাদা দিয়েছে।
আমাদের পরিপার্শ্বে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এতোবার উচ্চারিত হতে শুনেছি, যা অনেকের ভাষায় ‘বাড়াবাড়ি’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। আমাদের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে নেতিবাচক যেসব কথা এবং ধারণা বিবৃত হতে শুনেছি, তার সম্পর্কে কিছু যুক্তি-পাল্টাযুক্তি এবং বাস্তবতা বিষয়ে বর্তমান নিবন্ধকারের বক্তব্যটি পরিষ্কার ভাষায় উপস্থাপন করবার একটা দায় অনুভব করছি।
যিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করেন তার বয়স যতই হোক, তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পক্ষেই থাকবেন; আর যারা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজনীতি করেন, তারা নিজের দলগত অবস্থান ঠিক রাখতেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে এড়িয়ে যাবেন। কিন্তু যারা দল নিরপেক্ষ মানুষ, দল নিরপেক্ষ বাঙালি, তার বয়স যদি পঞ্চান্ন বছরের বেশি হয়, তবে তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আজও আবেগতাড়িত হবেন; কিন্তু কেন? কারণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ১৮ মিনিটের একটা ভাষণ কিভাবে গোটা বাঙালি জাতিকে প্রভাবান্বিত করেছে। একটা বক্তৃতায় কী পরিমাণ প্রাণশক্তি থাকলে মানুষ এতটা উদ্বেল হতে পারে; কী শক্তি থাকলে মানুষ এভাবে বুকের রক্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রত্যুত্তর দিতে পারে! স্বার্থন্ধতার রাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের সংস্কৃতিই ১৯৭৫-এর আগষ্ট থেকে বঙ্গবন্ধু নামের ঔজ্জ্বল্যে ‘গ্রহণ’ লাগিয়ে রেখেছে দীর্ঘ একুশ বছর; দীর্ঘ একুশ বছর ধরেই বাংলাদেশে চলেছে স্বাধীনতা বিরোধীদের দৌরাত্ম। একুশ বছর ধরে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন তাঁদের সবার ভয় ছিলো বঙ্গবন্ধুর নামের উপর; যে কারণে দীর্ঘ একুশ বছর ধরেই বাংলাদেশের সরকারি আঙিনায় অনুচ্চারিত থেকেছে বঙ্গবন্ধুর নাম; এবং এই একুশ বছরে বেশ ক’টি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ভুল ইতিহাসে Ñ ভুল ব্যাখ্যায়। মৃত্তিকার স্পর্শবিহীন বৃক্ষ যেমন উন্মূল, নিজস্ব সংস্কৃতি-কৃষ্টি আর ইতিহাসবিচ্ছিন্ন মানুষও তেমনি উন্মূল হতে বাধ্য; এবং দীর্ঘ একুশ বছর উন্মূল হয়ে বেড়ে উঠেছে বাংলার শিশুরা। আমাদের শিশুদের বাঙালির শৌর্য-বীর্য, পূর্বপুরুষের আত্মদানের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে এবং এভাবেই চেষ্টা চলেছে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে; কিন্তু পাহাড়ের আড়াল দিয়ে কি সূর্যালোককে লুকিয়ে রাখা যায়? যায় না বলেই বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছেন স্বমহিমায়; বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছেন তাঁর নিজের মহানুভবত্বের দ্যুতিতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের এই স্বীকৃতি তাঁর সগৌরব ফিরে আসার দৃষ্টান্ত।
৭ই মার্চের ভাষণের শক্তির জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করতে চাই। এসব চিহ্নিতকরণের কৃতিত্ব আমার নয়; এসব কথা বারবার বিভিন্নজন উচ্চারণ করেছেন; আমি অনেকের উচ্চারণকে সমন্বয় করতে সচেষ্ট হয়েছি মাত্র।
প্রথমত, অনেকেই বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা!’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরিপূর্ণতার দিকটি বুঝতে দেখবো, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের এক জায়গায় বলছেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছুÑ আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে!”। বঙ্গবন্ধুর এই যে দিকনির্দেশনা বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ১৯৭১-এ বাঙালি দা-বল্লম-লাঠি-তীর-ধনুক এমনকি ইট-পাথর নিয়ে সুসজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনির সাথে মোকাবেলা করার জন্যে বেরিয়ে এসেছে পথে। বাঙালির সেদিনের উন্মাদনার চিত্র লিখে বোঝানো অসম্ভব। এক কথায় বলতে পারি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যেন আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর মাথায় উঠে এসেছিলো। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলোÑকেউ দেবে না। শুনুন মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায়- হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিও আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা-পত্র নিতে পারে। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সাথে দেয়া-নেয়া চলবে না।” যে কেউ সামান্য মনোযোগ দিলেই বুঝবেন ভাষণের এ অংশে কতটা দূরদর্শিতা বিদ্যমান। অন্যত্র তিনি বলছেন, “এবারের আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!” এই যে ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘মুক্তি’ অর্জনের কথা তিনি পৃথকভাবে উচ্চারণ করলেন, তার মধ্যেও কী গভীর দর্শন কাজ করেছে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। লক্ষ করলেই দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু ‘মুক্তি’ বলতে মানুষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথাই বলেছেন; যা তাঁর ভাষণের প্রথম দিকেই তিনি উচ্চারণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কোন লিখিত ভাষণ নয়। তাৎক্ষণিকভাবে তার মাথায় বা চিন্তায় যা এসেছে, তাই তিনি উচ্চারণ করেছেন স্বতঃস্ফুর্ত ব্যাঞ্জণায়। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি যত কথা বলেছেন সবই তাঁর সম্যক উপলব্ধির কথা, সবই তাঁর জীবনাভিজ্ঞতার সাহসী উচ্চারণ; তাঁর এ ভাষণ তাঁর দেশপ্রেমেরও উদাহরণ। তাঁর ভাষণে তিনি যেসব কথা উচ্চারণ করেছেন, তার ফল যে তাঁর নিজের জন্য ভয়াবহ হতে পারে সে কথা তিনি জানতেন; এবং জানতেন বলেই তিনি বলেছেন, “আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি”। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কাপুরুষ ছিলেন না; কাপুরুষ ছিলেন না বলেই মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গনের স্পর্ধা দেখাতে পেরেছেন। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল বিদ্রোহীর যে চিত্র এঁকেছেন তারই যেন বাস্তব প্রতিফলন দেখলাম আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা !
আমি মহামারি, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
(বিদ্রোহী ॥ অগ্নি-বীণা ॥ কাজী নজরুল ইসলাম)
দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের জন্য অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলেটিক্স’ বলে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিদগ্ধ মানুষের এ উচ্চারণে বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই, সেটি সামান্য মনোযোগ দিয়ে তাঁর ভাষণটি শুনলেই উপলব্ধি করা যাবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে কবিতার দুই ধরণের ব্যবহার প্রবল; এক, কবিতার গতিময়তা এবং কবিতার প্রবহমানতা; দুই, নাট্যগুণের উৎকর্ষ। প্রথমেই কবিতার গতিময়তা এবং প্রবহমানতা প্রসঙ্গ; লক্ষ করলেই দেখা যাবে ১৮ মিনিটের ভাষণের বিভিন্ন অংশে শব্দ প্রক্ষেপণের গতিতে হ্রাস-বৃদ্ধি এবং শব্দ উচ্চারণের নিরবচ্ছিন্ন প্রবহমানতা শ্রোতাকে চমকিত করবেই। ভাষণের কিছু অংশ উদ্ধৃত করছিÑ“আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ‘ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।ৃ..” লক্ষ করে দেখুন বক্তৃতার এ অংশে অনুপ্রাসের ব্যবহার, দেখুন ছন্দময়তার সাবলীল গতি। অন্যদিকে ৭ই মার্চের ভাষণে ‘নাট্যগুণের উৎকর্ষ’ বুঝতে চাওয়ার আগে জেনে নেবো, সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের মতে নাটক দৃশ্যকাব্য; সঙ্গত কারণেই নাটকে কাব্যময়তা তার গুণপনারই উদাহরণ। আমি দু’টি বিখ্যাত নাটক থেকে দু’টি সংলাপের সামান্য কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি
“হাজার হাজার সৈন্য পলাশীর প্রান্তরে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো, আর পরাজয় পেছন থেকে এসে সকলের ললাটে লাঞ্ছনার কালিমা মাখিয়ে দিয়ে গেল! কৈফিয়ৎ কে দেবে? একা তোমাদের নবাব, না সিপাহসালারও? কোথায় তিনি? কোথায় সিপাহসালার, সেনাপতি ইয়ার লতিফ, রাজা রাজবল্লভ, ধনকুবের জগৎশেঠ? ডাকো তাদের এই দরবারে ! দাও তাদের দণ্ড।” (নবাব সিরাজদৌলা ॥ শচীন সেনগুপ্ত) অথবা “ভগবান স্বর্গে নেই দাদা! ভগবান আছে এই মর্ত্যরে মাটিতে ! সেই ভগবান কারা জানো, যারা তোমার আমার মতো অজস্র মানুষের বুকের পাঁজরে বাজিয়ে চলেছে জলতরঙ্গের বাজনা, যারা দেখেও দেখতে পায় না, শুনেও শুনতে পায় না! সেইসব পুঁজিপতি ভগবানের কাছে আর কোন আবেদন নয়, আর কোন নিবেদন নয়! মেহনতি মানুষের প্রচণ্ড সংঘ শক্তির আঘাতে তাদের ঐ খুশির অট্টালিকা ভেঙে চুরমার করে কায়েম করতে হবে মেহনতি মানুষের ন্যায্য অধিকার!’ (যাত্রাপালা: একটি পয়সা ॥ ভৈরবনাথ গঙ্গোপাধ্যায়)। যে দুটি নাটকের কথা বলা হলো, দু’টি নাটকই সারা বাংলায় বহুল অভিনীত। নাটকে সংলাপের যে কাব্যশক্তি, আশা করি উদ্ধৃত দু’টি সংলাপেই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান; প্রিয় পাঠক, একটু মনোযোগ দিলেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে একই শক্তির সন্ধান পেয়ে যাবেন, যে শক্তির জোরে কেবল ১৯৭১-এ নয়, বরং আজও তাঁর ভাষণ আমাদের উদ্বেলিত করে, উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত করে; তাঁর ভাষণ আমাদের উত্তেজনার চরমে পৌঁছে দেয়। আসুন এবার একটু ভাষণে মনোযোগী হই–“ভায়েরা আমার ২৫ তারিখ এসেমব্লি কল করেছে; রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসি-তে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এসেমব্লি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম, সামরিক আইন, মার্শল’ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে। যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর, জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেমব্লিতে বসতে আমরা পারি না। আমি প্রধান মন্ত্রীত্ব চাই না! আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।” বঙ্গবন্ধুর সেই কাব্যময় ভাষণের এতটাই শক্তি, ১৯৭১-এর ৮ই মার্চ থেকে বাংলাদেশে প্রতিটি কার্যক্রম বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের নির্দেশনা অনুযায়ী চলেছে; এমন নয় যে মানুষকে ভয় দেখিয়ে নির্দেশ মানতে বাধ্য করা হয়েছে; বরং প্রত্যেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মান্য করেছেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে যে ‘পয়েট অব পলেটিক্স’ বলা হয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য এবং আমাদের এই অবিসম্বাদিত কবি তাঁর ভাষণে যা কিছু উচ্চারণ করেছেন, তাই সত্যি হয়ে উঠেছে। আর তাঁর কবিতার প্রতিটি পংক্তি চিরকালীন ব্যঞ্জনা নিয়ে বাঙালির জীবনে প্রতিভাত হচ্ছে, প্রতিদিন অনুরণিত হচ্ছে। এমন একজন যোগ্য কবিকে মহাকালের কবি বলে মেনে না নিয়ে উপায় কি?
বাঙালির বিশিষ্ট সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রসঙ্গে বললেন, ‘সংক্ষিপ্ততম একটি মহাকাব্য, যেখানে একটিও তৎসম শব্দের ব্যবহার নেই। একেবারে সহজ সরল দেহাতি বাংলা।’ প্রকৃত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন পাঠ করলে দেখবো, হাজার বছরের শত-কোটি বাঙালির চরিত্র ঘেঁটে যদি একজন মহাকাব্যের নায়কের সন্ধান পাওয়া যায়, সেটি বাঙালি জাতির অহংকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে একদিকে যেমন বলা হয়েছে নায়কোচিত উপলব্ধির সাবলীল উচ্চারণ, অন্যদিকে বলা হয়েছে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দলিল। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নৃসংশভাবে শহীদ হবার পর থেকে সুদীর্ঘ সময় ভেবে আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যদি কাউকে নায়ক করে মহাকাব্য রচনা করা হয়, তাহলে সে মহাকাব্যের একমাত্র ‘মহানায়ক’ হবেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অবিসম্বাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাত্ত্বিকদের কাছে জেনেছি মহাকাব্যের দিন শেষ হয়ে গেছে, হয়তো তাই সত্য; কিন্তু যদি কোনো নতুন মহাকাব্য রচনার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং তা বাঙালির জীবন ঘিরে হয় তবে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র বাঙালি যিনি মহাকাব্যের মহানায়ক হবার যোগ্যতা রাখেন। নায়ক হয়ে ওঠার বৈশিষ্ট্য তাঁর চরিত্রে দেখা দিয়েছিলো শৈশবেই; এবং নিজের জীবনটিকে তিনি রচনা করেছেন নায়কোচিত বৈশিষ্ট্যে, আর নিয়তি তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে বীরোচিত মহাপ্রয়াণের দিকে। তার চেয়েও বড় কথা বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক দৃঢ়তা-আত্মবিশ্বাস এবং সৎসাহস তাঁকে ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ রাত্রিতে যেমন সমগ্র জাতিকে অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করেনি, একইভাবে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্ট রাতে দুর্বৃত্তদের বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেও ভীত করেনি। বাঙালির এই মহানায়ক তাই আজ পূজিত হচ্ছেন বিশ্বে এবং তাঁকে ঘিরে এ বন্দনা চলতেই থাকবে। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদেরকে সেই মহানায়ককে চিনে নিতে সাহায্য করে। মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে লেখা আমার একটি অক্ষম কবিতা দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা উচ্চারণের মাধ্যমে আজকের রচনার ইতি টানবো।:
নেতা এবং পিতা তিনি বিশাল হৃদয়-মন
জয় করলেন বাংলা এবং বিশ্বের অঙ্গন,
বাংলা মায়ের সন্তান তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয়
পথের মানুষ পেয়েছে তাঁর গায়ের উত্তরীয়,
সবার কথা কইতে জীবন কেটে গেল জেলে
উদার-জমিন হৃদয় এমন হাজার বর্ষে মেলে
শিশুর মতো মন ছিলো তাঁর বজ্র-কঠিন পণ
মুক্ত-স্বাধীন বঙ্গভূমি স্বপ্ন আমরণ।
তর্জনীতে স্বপ্ন জাগে দীপ্ত আহবানে
বজ্রকণ্ঠ গর্জে ওঠে রেসকোর্স ময়দানে
আহবান তাঁর ছড়িয়ে যায় গঞ্জ থেকে গ্রামে
যুদ্ধে মাতে বৃদ্ধ-যুবা শেখ মুজিবের নামে;
‘খোকা’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ছুঁলেন সাত-আসমান
তাঁরই নামে শীর্ষতে আজ বাংলার সম্মান।