দীর্ঘ ১৭ বছরেও শেষ হয়নি কিবরিয়া হত্যাকান্ডের বিচার, হতাশা ও ক্ষোভ পরিবারের

6

স্টাফ রিপোর্টার :
হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারের মর্মান্তিক দুর্বৃত্তদের ভয়ানক গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকান্ডের বিচার দীর্ঘ ১৭ বছরেও শেষ হয়নি। হবিগঞ্জ-লাখাই ৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন শাহ এএমএস কিবরিয়া। ওই হামলায় শাহ এএমএস কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদাসহ প্রাণ হারান আরও ৩ জন। এছাড়াও আহত হন কমপক্ষে আরো শতাধিক নেতাকর্মী। এ ঘটনার পূর্ণ হয়েছে ১৭ বছর। গতকাল শুক্রবার ২৭ জানুয়ারি।
এ ঘটনায় দীর্ঘ ১৭ বছরেও বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে নিহতদের পরিবারসহ জেলাবাসির মধ্যে। সাধারণ মানুষের একটাই দাবী এই সরকারের আমলেই যেন নির্মম এ হত্যাকান্ডের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়।
এদিকে, শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১৮তম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা ও হবিগঞ্জে বিভিন্ন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে ছিলো হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শোক র‌্যালি, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা। এছাড়া ঢাকার বনানীতে অবস্থিত মরহুমের কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ড. রেজা কিবরিয়াসহ তার পরিবারের সদস্যরা। সেখানে জিয়ারত ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মসূচিতে আত্মীয় স্বজনসহ শুভাকাক্সক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, আমার বাবার হত্যাকান্ডের পর থেকেই আমরা দাবী জানিয়ে আসছিলাম একটা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের। কিন্তু সেই বিচার এতদিনেও হয়নি। কেন সেটা হয়নি দেশের মানুষ এখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। তিনি বলেন, বর্তমান এই সরকার থাকাকালীন এখন আমরা আর একটা সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার আশা করি না। পরবর্তী সরকারে কি হয় সেটা দেখা যাবে। তিনি বলেন, আমি মনে করি তখন একটা সুযোগ হবে সঠিক একটা তদন্ত করার। যেটা রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত হবে না। নির্মম এই হত্যাকান্ডের পেছনে আসল মদদদাতারা কে, গ্রেনেডের উৎস কি তদন্তে এই ব্যাপারে পুলিশের কোন আগ্রহ ছিল না। আমরা বিচারের জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করেছি হয়তো আরো কিছুদিন অপেক্ষা করব।
ফিরে দেখা বৈদ্যের বাজার ট্র্যাজেডি :
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। তার উপস্থিতিতে জনসভা ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। সভা শেষে যখন তিনি সহকর্মীদের নিয়ে বৈদ্যের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেইটে আসেন তখন দিনের আলো নিভে প্রায় সন্ধ্যা। আর ঠিক সেই সময়েই তাকে লক্ষ্য করে ভয়ানক গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটায় দুর্বৃত্তরা। বিকট শব্দ শুনে চারদিকে শুরু হয় হৈচৈ। হুড়োহুড়িতে শোনা যায় গগনবিদারী চিৎকার। গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হন শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ অনেক নেতাকর্মী। স্থানীয় লোকজন ক্ষত-বিক্ষত কিবরিয়াসহ আহতদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে। শাহ এএমএস কিবরিয়া ও তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোঃ আবু জাহিরের প্রচন্ড রক্তক্ষরণ কোন ভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না। এ সময় দ্রুত হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে না পেরে এ্যাম্বুলেন্সে করেই কিবরিয়া ও আবু জাহিরসহ অন্যান্য আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা যাওয়ার পথে রাস্তায়ই শাহ এএসএম কিবরিয়া অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান। তার মৃত্যুতে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি। হরতাল অবরোধে হবিগঞ্জ শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
কিবরিয়া হত্যা মামলা ও তদন্ত কার্যক্রম :
এ ঘটনার পরদিন ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান এমপি বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু মামলাটির স্বাভাবিক তদন্ত না হয়ে দলীয় বিবেচনায় পরিচালিত হতে থাকে। সিআইডি’র তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ ১ম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগপত্রে তৎকালীন জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আবদুল কাইয়ুম, জেলা বিএনপির কর্মী ও ব্যাংক কর্মকর্তা আয়াত আলী, কাজল মিয়া, জেলা ছাত্রদলের সহ-দপ্তর সম্পাদক সেলিম আহমেদ, জিয়া স্মৃতি গবেষণা পরিষদ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আলী, বিএনপি কর্মী তাজুল ইসলাম, বিএনপি কর্মী জয়নাল আবেদীন জালাল, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা জমির আলী, ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন মোমিন ও ছাত্রদল কর্মী মহিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়। আব্দুল কাইয়ুমকে স্বীকারোক্তির জন্য ৪৭ দিন রিমান্ডে নেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অভিযোগপত্র দেয়ার পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে নারাজি আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করেন। এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামী করে এই আলোচিত মামলার অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করেন। কিবরিয়া হত্যাকান্ডের সাড়ে ৬ বছর পর লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামী করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল। সম্পূরক চার্জশীটে ১ম ১০ জনের বাইরে অভিযুক্তরা হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, লস্কর ই তৈয়বা সদস্য আব্দুল মজিদ কাশ্মীরি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু’র ভাই মাওলানা তাজ উদ্দিন, মহিউদ্দিন অভি, শাহেদুল আলম দিলু, সৈয়দ নাঈম আহমেদ আরিফ, ফজলুল আলম মিজান, মিজানুর রহমান মিঠু, মোহাম্মদ আব্দুল হাই, মোহাম্মদ আলী, মুফতি সফিকুর রহমান, বদরুল এনায়েত মোঃ বদরুল, বদরুল আলম মিজান।
২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশীটের উপর হবিগঞ্জ জুডিসিয়াল আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। আবেদনে আসমা কিবরিয়া উল্লেখ করেন, যেহেতু তদন্তকারী কর্মকর্তার দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে উলে¬খ রয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, চারদলীয় জোটের অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতা কর্মীদের পরস্পর যোগসাজসে হরকাতুল জিহাদ সদস্যদের সহায়তায় ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা, সিলেটের মেয়র বদর উদ্দিন কামরানের উপর দুই দফা হামলা, আওয়ামীলীগের এমপি জেবুন্নেছা হকের বাসায় গ্রেনেড হামলা, বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা, সুরঞ্জিত সেনের জনসভায় গ্রেনেড হামলা ও কিবরিয়ার উপর বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু অন্য কারো নাম অভিযোগপত্রে নেই। তাই তা যথাযথভাবে তৈরি হয়নি। এছাড়াও তৎকালীন জেলা প্রশাসক এমদাদুল হককে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মূল তথ্য উদঘাটন হবে বলে আসমা কিবরিয়া দাবি করেন। তিনি আরও দাবি করেন, অভিযোগপত্রে দন্ডবিধি ১১৪ ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এই ধারা কার উপর বর্তায় তা পরিস্কার ভাবে সামনে আসেনি। তার দৃঢ় বিশ্বাস, অভিযোগপত্রে যাদের নাম এসেছে তার বাইরেও আরও অনেকেই জড়িত রয়েছেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকান্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের না-রাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র ঃ
২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার ৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি সিলেট অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মেহেরুন নেছা পারুল। অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। অন্তর্ভূক্ত আসামীরা হলেন, সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া। একই সাথে পূর্বের চার্জশীটভূক্ত ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আব্দুল করিম ও মরহুম আহছান উল¬াহকে চার্জশীট থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। ৩ ডিসেম্বর মামলার শুনানিকালে অভিযোগপত্রে ক্রুটির কথা উলে¬খ করে সংশোধিত অভিযোগপত্র জমা দেয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ প্রেক্ষিতে ২১ ডিসেম্বর সংশোধিত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। একই সাথে পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির আদেশ দেয়া হয়। ২৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ৩২ জনকে আসামী ও ১৭১ জনকে সাক্ষী করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরুন নেছা পারুল।
সিসিক মেয়র আরিফ ও হবিগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন মেয়র গউছের আত্মসমর্পণ ঃ
৩য় দফা সম্পূরক চার্জশীট গৃহিত হওয়ার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন হবিগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন মেয়র জি কে গউছ। এর দু’দিন পর একই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন সিলেট সিটি কর্পোরেশন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। দীর্ঘ কারাবাসের পর ৪ জানুয়ারী ২০১৭ আরিফুল হক চৌধুরী ও জিকে গউছ জামিনে মুক্তি পান। হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ৪৭ জন ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করার মামলায় ১৪ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।