কাজিরবাজার ডেস্ক :
শহীদুল্লা কায়সার ‘শহীদের মাকে’ কবিতায় লিখেছেন- ‘যে ছেলে তোমার গানের পাগল/কেমন করে রুখবে তাকে/ঘরে দিয়ে আগল?’ কবিতায় গানে গল্প উপন্যাসে মায়ের ভাষা বাংলা নিয়ে এভাবেই আবেগ প্রকাশ হয়েছে বাংলার শিল্প সাহিত্যে। ’৫২ ভাষা আন্দোলনে বীর বাঙালিকে প্রেরণা জুগিয়েছে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম। বীর বাঙালি পাকি শাসক গোষ্ঠীকে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত করেছে। দীর্ঘ ১৯ বছরের লড়াই সংগ্রামের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। তাই ভাষা আন্দোলনই বীর বাঙালির প্রেরণার উৎস। ১৯৪৮ সালের ১৮ নবেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্বপাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়। কিন্তু তিনি কোনরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নবেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোন সাড়া দেননি।
বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ভাষা আন্দোলনের মতো আবেগিক বিষয়ের পুনরায় জোরালো হওয়ার পেছনে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহর কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে কোন জাতি দুটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তারা তাদের মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) দিকে অগ্রসর হয়। পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। সভায় আরবী লিপিতে বাংলা লেখার সরকারী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়া হয়। পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।
১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকেই কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড বাংলা ও অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা আরবী হরফে লেখার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ পেশ করেছেন বলে একটি খবর প্রচারিত হয়। পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলাকালে ২৯ মার্চ মনোরঞ্জন ধর পরিষদে এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর জবাবে মন্ত্রী একটি লিখিত বিবৃতিতে বলেন যে, শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড পূর্ব বাঙলা অথবা অন্য কোন প্রাদেশিক সরকারের কাছে অনুরূপ কোন প্রস্তাব বা সুপারিশ পেশ করেন নেই। সরকারীভাবে প্রাদেশিক মন্ত্রী আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্রকে অস্বীকার করলেও সে বিষয়ে ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহের অবসান ঘটেনি। এই সন্দেহের মূল কারণ প্রশ্নটি শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের বিবেচনাধীন ছিল। আরবী হরফকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের মাধ্যমে বাঙালীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ছাত্র সম্প্রদায় এবং জনসাধারণকে সাবধান করার উদ্দেশে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের ‘ভাষা কমিটির’ পক্ষ থেকে নঈমুদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে লিখিত বিবৃতি দেয়া হয়। বিবৃতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত গত বছরের প্রস্তাবটি উর্দু চাপানোর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল। আর একই পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবকে বাতিল করতে পারে না। ভবিষ্যতে নবনির্বাচিত পরিষদও এই প্রস্তাব নাকচ করবার সাহস করবে না। কাজেই উর্দুর জন্য সামনের দুয়ার যখন বন্ধ তখন আরবী বর্ণমালার জিগীর তুলে পশ্চাৎ দুয়ার দিয়ে উর্দু প্রবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে এবং পরিষদ গৃহীত প্রস্তাব ও বাংলা ভাষাকে খতম করার ষড়যন্ত্র চলছে।