কাজিরবাজার ডেস্ক :
বায়ান্নর চেতনায় উদ্ভাসিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু হয়েছে। প্রতিবারের মতোই বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি এ মেলার আয়োজন করছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে শুক্রবার মাসব্যাপী মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় গ্রন্থমেলাকে প্রাণের মেলা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি শুধু বই কেনা বেচার জন্য নয়, আমাদের বাঙালির প্রাণের মেলা। মনটা পড়ে থাকে এই গ্রন্থমেলায়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আয়োজক বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সম্মানিত বিদেশী অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ এবং মিসরের প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক ও গবেষক মোহসেন আল-আরিশি। প্রকাশক প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে যখন ক্ষমতায় ছিলাম না তখন গ্রন্থমেলায় আসতাম। ঘুরে বেড়াতাম। এখন বলতে গেলে এক ধরনের বন্দী জীবনযাপনই করতে হয়। আসার আর সুযোগ হয় না। আসতে গেলে অন্যের অসুবিধা হয়। নিরাপত্তার কারণে মানুষের যে অসুবিধা হবে তা বিবেচনা করে আর আসার ইচ্ছাটা হয় না। তবে সত্যি বলতে কী মনটা পড়ে থাকে এখানে।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির এই যুগে মুদ্রিত বই কি হারিয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন পুরনো। এদিন নতুন করে প্রসঙ্গটি সামনে আনেন অনুষ্ঠানের সভাপতি আনিসুজ্জামান। একই প্রসঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতই আমরা যান্ত্রিক হই না কেন, বইয়ের চাহিদা কখনও শেষ হবে না। নতুন বইয়ের মলাট, বই শেলফে সাজিয়ে রাখা, বইয়ের পাতা উল্টে পড়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, আমরা সবসময় তা পেতে চাই। সামনে বসে থাকা বইপ্রেমীরা করতালির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান। তবে একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সব বই অনলাইনে বই দেয়া এবং ডিজিটাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠারও ওপরও জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। বহু কষ্ট করে মাসব্যাপী মেলার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। এজন্য একাডেমিকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, গ্রন্থমেলা আয়োজন করে বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী এদিন ইতিহাস জানার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। বাঙালির ইতিহাস আত্মত্যাগের উল্লেখ করে আগামী প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে জানার আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ গ্রন্থ সিরিজের দ্বিতীয় খন্ডের আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত গোয়েন্দাগিরি করে জাতির জনকের বিরুদ্ধে যেসব রিপোর্ট দিয়েছিল, সেগুলোর ভিত্তিতে এ সিরিজ গ্রন্থ প্রকাশ করা হচ্ছে। আগে প্রথম খন্ড প্রকাশ করা হয়েছে। এবার এলো দ্বিতীয় খন্ড।
বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগকে সাহসের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন নেতার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া রিপোর্ট বই আকারে প্রকাশ করার নজির নেই। আমি জানি না পৃথিবীর কোথাও অতীতে কেউ এই ধরনের প্রকাশনা করেছে কিনা। এসব দলিলে আপনারা অনেক তথ্য পাবেন। একজন নেতা কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কী বললেন, কারাগারে থাকা অবস্থায় তার কাছে লেখা চিঠি বা তিনি যেসব চিঠি লিখেছেন বা যোগাযোগ করেছেন- এসব বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করছি আমরা।
তিনি বলেন, এসব তথ্য ইতিহাস বিকৃতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। সত্যকে উদ্ভাসিত করতে পারে।
দুর্লভ দলিল উদ্ধারের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পরই আমি গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করি। একটি করে কপি আমার কাছে রেখে মূল দলিল এসবির কাছে পাঠিয়ে দিই। পরে আমি এবং আমার বান্ধবী বেবী মওদুদ দুজন দিনের পর দিন একসঙ্গে বসে পড়ি। তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। তখন আরও ভালভাবে উপলব্ধি করি যে, এগুলো অমূল্য সম্পদ।
তিনি বলেন, এখানে ৪৬টি ফাইল ৪৮টি খন্ড ছিল। ২০০৯ সালে সরকারে আসার পর প্রকাশ করার পদক্ষেপ নিই। সিরিজের মোট ১৪ খন্ড প্রকাশিত হবে বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী এদিন গুরুত্বপূর্ণ দলিলের ভিত্তিতে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। জাতির পিতা যখন আইন বিভাগের ছাত্র সেসময় এই আন্দোলন শুরু করেন। সদ্য প্রকাশিত বইতে তথ্য পাওয়া যায় যে, জাতির পিতা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেন। তমদ্দুন মজলিস ছাত্রলীগ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন সকলকে নিয়ে একটি ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন। ১১ মার্চ থেকে সে আন্দোলন কর্মসূচী শুরু হয়।
বই থেকে একটি প্রতিবেদন পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী, যেখানে বলা হয়- শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ গোপালগঞ্জে হরতাল ডাকা হয়। বিকেলে এসএম একাডেমি এবং এমএন ইনস্টিটিউটে ৪০০ ছাত্র শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। স্লোগান ছিল: রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। নাজিম উদ্দীন নিপাত যাক। মুজিবকে মুক্তি দাও।
তিনি বলেন, অর্থাৎ আন্দোলনের শুরুতেই ১১ মার্চ শেখ মুজিবসহ অনেক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় জুুলুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ছাত্র ছাত্রীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় শেখ মুজিব, দবিরুল ইসলাম ও নাদিরা বেগম বক্তৃতা করেন। সভায় শেখ মুজিব বলেন, এক মাসের মধ্যে ছাত্রদের ন্যায্য দাবি পূরণ করা না হলে ছাত্ররা প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ১৯৭ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী। এই পাঠ থেকেও ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পরও আন্দোলন করতে হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান অনশন করে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। এবং ৩০ মে খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি পেশ করতে করাচিতে যান। সেখানে পেশ করা স্মারকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এভাবে ভাষা আন্দোলনে মুজিবের অজানা অধ্যায় সবার সামনে তুলে ধরেন তারই কন্যা। পরে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ঘুরে দেখেন তিনি।
শেখ হাসিনাকে নিয়ে নতুন অনুবাদ গ্রন্থ : বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে আরবী ভাষায় লেখা বইয়ের অনুবাদ ‘শেখ হাসিনা : যে রূপকথা শুধু রূপকথা নয়।’ মিসরের সাংবাদিক লেখক মোহসেন আল-আরিশি রচিত বইয়ের বাংলা অনুবাদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান : উদ্বোধনী মঞ্চে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮ প্রদান করা হয়। এ বছর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে আফসান চৌধুরী, প্রবন্ধ ও গবেষণায় সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, কবিতায় কাজী রোজী, কথাসাহিত্যে মোহিত কামাল এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। প্রত্যেকের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
মেলার সময়সূচী : গ্রন্থমেলা ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩টায় শুরু হবে। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। ছুটির দিন সময় বাড়বে। বেলা ১১টায় খুলে দেয়া হবে দ্বার। বন্ধ হবে রাত ৯টায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসে সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে মেলা চলবে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।