উন্নয়নের গতি ও আগামী নির্বাচন

82

নাজনীন বেগম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের অব্যাহত গতিধারায় যেভাবে দেশ ও মানুষের অগ্রগামিতা নিশ্চিত করেছে, তা শুধু দৃশ্যমানই নয়, সর্বমানুষের হাতের নাগালে এর সুফল পৌঁছাতেও সময় লাগেনি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো থেকে আরম্ভ করে প্রবৃদ্ধির প্রতিটি সূচকে এ অগ্রযাত্রার সম্পৃক্ততা দেশকে এক অনন্য মাত্রায় চালিত করছে। সময়টা খুব বেশি নয়Ñ মাত্র দশ বছর। আর দুর্যোগের ঘনঘটায় সারাদেশ আবর্তিত হয়েছে দুই যুগেরও অধিক সময়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচিত সরকার গঠিত হলে সেই ২১ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য মাত্র পাঁচ বছর ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক কম সময়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার নৃশংস রক্তাক্ত ইতিহাসের দুঃসহ যাত্রায় পরবর্তী বছরগুলোতে যে অমানিশার অন্ধকার ঘনিয়ে আসে সেখান থেকে বের হওয়াও ছিল অবর্ণনীয় মহাসঙ্কট। ১৫ আগস্টের রক্তগঙ্গার স্রোতে ভাসমান পুরো দেশ নতুন করে আবারও প্রত্যক্ষ করল আরও এক দুঃসহ বেদনাঘন নির্মম হত্যাযজ্ঞ। মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে রক্তস্নাত মহাযজ্ঞের দুর্বিপাকে সারা জাতি বিস্ময়ে, শোকে হতবাক হয়ে যায়। ৩ নবেম্বর বঙ্গবন্ধুর চার ঘনিষ্ঠতম সহযোদ্ধার মৃত্যুর মিছিল পুরো দেশ আবারও নির্মম পরিণতির শিকারে ইতিহাস বিকৃতির পথে নিপতিত হয়। এমনতর জঘন্য হত্যাকান্ড যাদের দ্বারা সংঘটিত হয় তাদের অনুসারীরা সুস্থ রাজনীতি, যথার্থ দেশপ্রেম কিংবা সুষ্ঠু নির্বাচনই শুধু নয়, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বলতেও যে কি বোঝায় সেটা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। অকারণে-অপ্রয়োজনে, বিনা বিচারে নির্দোষ নেতৃত্বের ওপর যে বীভৎস রক্ত বন্যা বয়ে যায় সে হিসাব তো সংশ্লিষ্টরা আজও দেয়নি। হত্যা, গুম, বিচার বিভাগকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা এসব ব্যাপারে আদৌ কি তারা উদ্বিগ্ন?
তা না হলে ’৭৫-এর আগষ্ট কিংবা পরবর্তী নবেম্বরে অথবা আরও পরে ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার বিচার হওয়া তো দূরের কথা, বরং না হওয়ার সমস্ত ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করে নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ কোন অপরাধবোধ ছাড়া বছরের পর বছর নির্বাচনের নামে প্রহসনই শুধু করেনি, জবর-দখলের অনন্য নজির স্থাপন করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ ইতিহাসকে বিকৃতই শুধু করা হয়নি, তার চেয়েও বেশি স্বাধীনতাবিরোধীদের অপকৌশল আর অপশক্তি প্রয়োগ করে মুক্ত দেশের সুস্থ আবহকেও লাঞ্ছিত করা হয়। ১৯৭৫ পরবর্তী দুঃসহ ইতিহাস এখানেই থেমে থাকেনি, অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার হত্যার বিনিময়ে সে পথ আরও পিচ্ছিল আর কলঙ্কিত হয়েছে। সে দায়ভাগ যাদের ওপর বর্তায় তারা কখনও বিকৃত ইতিহাসের এমন পঙ্কিল অধ্যায়ের নিন্দায় কোন ধরনের উচ্চবাচ্য করেননি। সে হিসাব যদি আজ পুরো জাতি কড়ায়-গন্ডায় মিটিয়ে নিতে চায় তাহলে অভিযুক্তরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এসব শোকাবহ, রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহ গুম-হত্যা কিংবা আড়ালে-আবডালে হয়নি। বীরদর্পে ’৭৫ পরবর্তী অনির্বাচিত সরকার প্রকাশ্যে, দিবালোকে এমন মানবতাবিবর্জিত দুর্ঘটনাকে জনসমক্ষেই স্পষ্ট করেছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করার দুরভিসন্ধিতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা যেভাবে উন্মাদ আর নৃশংস হয়ে ওঠে, সেই সুযোগটুকু গ্রহণ করতে বিদেশী অপশক্তিও কালক্ষেপণ করেনি। ৩ নবেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতার যে রক্তাক্ত পরিণতি তা আজও আমাদের শিহরিত করে, এক অনভিপ্রেত দুর্যোগের দুঃশাসনে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। কিন্তু যারা এমন ধরনের হত্যাকা-ের ধারাকে জিইয়ে রেখে ২১টা বছর রাজসিংহাসন জবর-দখল করে অপশাসন চালিয়ে যেতে দ্বিধা করেনি, তাদের দুঃসাহসে আজও জাতি বিস্ময়ে হতবাক হয়। এর পরেও তারা থেমে থাকেনি। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় পুরো অনুষ্ঠান। এখানেও সেই আওয়ামী লীগকে পুনরায় নেতৃত্বশূন্য করার এক দুর্নিবার অভিসন্ধি। সে সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি জোট সরকার সমস্ত দায় চাপায় আওয়ামী লীগের ওপর। ‘জজ মিয়া’ নাটক তৈরি করে এত বড় অন্যায়কে ধামাচাপা দেয়ার সমস্ত অপকৌশল করলেও সত্যিটা প্রকাশ হতেও দেরি হয়নি। তারেক রহমানের নৃশংস পরিকল্পনায় বিএনপির মন্ত্রী, উপমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে কত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম মামলায় অধিভুক্ত হয় তার একমাত্র সাক্ষী বিচার প্রক্রিয়ার হরেক রকম তথ্য-উপাত্ত।
প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সারাদেশ ও মানুষের উন্নয়নের গতিধারায় নিজেকে নিঃশেষে, নিঃশর্তে সমর্পণ করেছেন সে দৃষ্টান্ত অনেক নেতৃত্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই। যে যোগ্য আসনে আজ তিনি নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন সেখান থেকেও সামান্যতম চ্যুত করার অধিকার আর সুযোগ কারও হাতে নেই। দল মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই রাজনৈতিক অকুতোভয় ব্যক্তিত্ব যে মাত্রায় প্রবৃদ্ধির স্রোত অবারিত করেছেন সেখানে তার তুলনা তিনি নিজেই। এই অকৃত্রিম, আদর্শনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে নিজের আকাক্সক্ষা আর প্রত্যাশাকেও এক সুতায় গেঁথে নিয়েছেন। দেশ এবং জনগণ ছাড়া অন্য কিছু তাকে ভাবায় না। জনগোষ্ঠী তার প্রধানতম শক্তি এবং ক্ষমতার উৎসÑ সেটা মুহূর্তের জন্যও তিনি ভুলে যান না। যেদিন থেকে বুঝতে পারলেন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ ও জাতির জন্য অশুভ সেদিন এই অনাহূত শাসন ব্যবস্থাকে বাতিল করতে তাকে ভাবতে হয়নি। ১৯৯০ সাল থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যে নতুন পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয় সে ধারা চলতে থাকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। এই দশ বছরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পালাক্রমে নির্বাচনে জয়ী হয়। একমাত্র ২০০০ সালেই শেখ হাসিনা বিধিসম্মত উপায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নীরবে, নিঃশব্দে আইনগত প্রথাকে সম্মান জানান। আর সেখানে বিএনপি যা করেছিল তা আজও ইতিহাসের কালো অধ্যায়।
পরবর্তীতে ২০০৭ সালে আবারও নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি সরকার যে অরাজক অবস্থার বিপদ সঙ্কেত তৈরি করে সেখান থেকে কারও পক্ষে বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি। সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেনা সমর্থন ছাড়া দায়িত্ব নিতেও শঙ্কিত হচ্ছিল। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে যে অনির্বাচিত সরকার সুদীর্ঘ ২ বছর তাদের শাসন কায়েম করেছিল সেটাও দেশকে কোনভাবেই এগিয়ে দিতে পারেনি। বিধিবহির্ভূত এমন শাসন ব্যবস্থা কোন এক পর্যায়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় বাধ্য হয়। নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠনে এগিয়ে যায়। ২০০১ থেকে ২০০৭ জাতীয় জীবনে যে সন্ত্রাস, মৌলবাদের উত্থান, জঙ্গীগোষ্ঠীর নগ্ন থাবা, দুর্নীতি, হত্যার মতো অনাকাক্সিক্ষত ষড়যন্ত্রÑ সব মিলিয়ে এক বিপন্ন সঙ্কটকাল জাতি পার হতে থাকে। সেখান থেকে উত্তরণের হাল ধরেন অত্যন্ত শক্ত হাতে নির্বাচিত নতুন সরকারের প্রধান নেতৃত্ব শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সুসংহতভাবে দেশকে এগিয়ে নেয়ার যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তা বাস্তবায়নেও সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। সেই যে শুরু করলেন গত দশ বছরে তার পর্যায়ক্রমিক ধারায় দেশ এখনও এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের অঙ্গীকার পূর্ণ করাই শুধু নয়, আধুনিক সময়ের কর্মোদ্যোতনাকে নতুন নতুন প্রকল্পে জনগণের সামনে হাজির করলেন। তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান অগ্রগামিতায় দেশ ও মানুষের নিরবচ্ছিন্ন যোগসাজশে বর্তমান প্রজন্মকে বিশ্বসভায় নিয়ে যেতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিলেন। সর্বসাধারণের নিরন্তর সম্পৃক্ততায় দেশ শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক অবস্থানেও অংশীদারিত্ব প্রমাণ করল। বিভিন্ন বিশ্ব জরিপে বাংলাদেশের এই সম্প্রসারিত সমৃদ্ধি আজ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে স্থান নিতে দেরি হলো না। সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বসভায় নজরকাড়া। অর্ধাংশ নারী জাতিকে উন্নয়নের অগ্রগামিতায় বিশেষভাবে সম্পৃক্ত করতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের রোল মডেল। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ এই খাতকে অনেকটা সর্বজনীন অবস্থায় পৌঁছেও দিচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নই শুধু নয় কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিকীকরণেও দেশ আজ অনন্য উচ্চতায়। সবজি এবং মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীতে একেবারে তৃতীয়তম। আর ধান ফলনে দেশ চতুর্থ স্থান দখল করে আছে। এসব খাতে নারীদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ উৎপাদনের নিয়ামক শক্তি। অগ্রযাত্রার এই পর্যায়ক্রমিক ধারা যে মাত্রায় বেগবান সেখানে আরও গতি সঞ্চার করে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত জরুরী। আর সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প কোন সুযোগ্য নেতৃত্ব এখনও দৃশ্যমান নয়। দেশকে একেবারে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিতে গেলে ধারাবাহিকতাকে আমলে নেয়া যুক্তিসঙ্গত। আর তার জন্য শেখ হাসিনার সক্রিয় উপস্থিতি দেশ ও মানুষের কল্যাণে বিশেষ গুরুত্ববহ। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যে সমৃদ্ধির স্রোতে দেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা, আধুনিক প্রযুক্তিগত উদ্যোগকে সময়ের গতিপ্রবাহে সম্পৃক্ত করা সবই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে তারই নির্দেশিত রূপরেখায়। আগত নির্বাচনের ব্যাপারে এসব প্রাসঙ্গিক গতিধারাকে বিবেচনায় আনা অত্যন্ত জরুরী। বিএনপি জোটের নির্বাচন নিয়ে আপত্তিকর, অসাংবিধানিক কোন অযৌক্তিক নির্দেশনা মানা যায় না। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে প্রচলিত নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশেও সেই আইনগত প্রক্রিয়ায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন আছে। তাদের দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সবাইকে উপহার দেয়া। নিশ্চয়ই এই নির্বাচন কমিশন সেই লক্ষ্যে নির্বাচনকে পরিচালিত করবে। এই মুর্হূতে জাতির কাছে এটাই বড় প্রত্যাশা।