ফিলিস্তিনই চ্যাম্পিয়ন

58

স্পোর্টস ডেস্ক :
বলুন তো, ফুটবল মাঠে কোন ঘটনায় হৃদয় বিদীর্ণ হয়? হৃদয়ে ঘটে রক্তক্ষরণ? অশ্রুজলে ভাসাতে হয় বুক? মাথায় ভেঙ্গে পড়ে আকাশ? আক্ষেপের অহর্নিশ অনলে পুড়তে হয় অনুক্ষণ? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। সেটা হলো টাইব্রেকার ট্র্যাজেডি। নকআউট পর্বের খেলায় নির্ধারিত ৯০ মিনিটে যখন দু’দলের স্কোর সমান বা ‘টাই’ থাকে, তখন আরও অতিরিক্ত ৩০ মিনিট (দু’অর্ধে ১৫ মিনিট করে) খেলা হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও যখন খেলার জয়-পরাজয় নিষ্পত্তি হয় না, তখনই মঞ্চস্থ হয় সেই টাইব্রেকার নামক লটারি। পাঁচটি করে পেনাল্টি শট মারবে দু’দলের ফুটবলাররা। যারা বেশি গোল করতে পারবে তারাই জিতবে। এমন টাইব্রেকার নাটকই শুক্রবার মঞ্চস্থ হলো ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। যাতে জয়ী হয়েছে ‘লায়ন্স অব ক্যানান’ খ্যাত ফিলিস্তিন। তারা টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে হারায় ‘দ্য পার্সিয়ান লায়ন্স’ খ্যাত তাজিকিস্তানকে। তাজিকিস্তানের ছিল প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ। কেননা গ্রুপপর্বের মোকাবেলায় এই ফিলিস্তিনের কাছেই তারা হেরেছিল ২-০ গোলের ব্যবধানে।
সিলেট ও কক্সবাজার ঘুরে ঢাকায় এসে শেষ হলো ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা’র খেলা। শিরোপা জেতার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন বনে গেল এ আসরের নতুন চ্যাম্পিয়ন।
সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘলা। বৃষ্টি হবে হবে ভাব কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। এর সুফল পেয়েছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ। বর্ষণ না হওয়াতে মাঠটা আর কর্দমাক্ত হয়নি। এমনিতেই এ মাঠের জল নিষ্কাশন পদ্ধতি সুবিধের নয়। বৃষ্টি হলে ঝামেলা হয়ে যেত। হয়নি বলেই দারুণ উপভোগ্য-প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি ফাইনাল খেলা দেখার সৌভাগ্য হলো স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হাজির ১২ হাজার দর্শকের।
ফিলিস্তিনের জার্সির রং ছিল লাল, আর তাজিকিস্তানের সবুজ। এক রসিক দর্শক বললেন, ‘ফাইনালে লাল-সবুজ জার্সিধারী বাংলাদেশ খেলেনি তো কি হয়েছে, দুই দলের জার্সি তো ঠিকই লাল আর সবুজ ছিল!’
দু’দলই খেলে গতিশীল এবং আক্রমণাত্মক ফুটবল। ম্যাচের ৩৪ মিনিটে দশজনের দলে পরিণত হয়েও দুর্দান্ত খেলে তাজিকিস্তান। বাকি সময়টা তারা এমনভাবে খেলে যেন তাদের কোন খেলোয়াড় কমতি নেই। বরং উল্টো তারা পাল্টা আক্রমণ করে বারবার ত্রাসের সঞ্চার করে ফিলিস্তিনের রক্ষণভাগে। তাজিকদের রুখতে রীতিমতো হিমশিম খেয়েছে তারা। মনে হচ্ছিল ফিলিস্তিনেরই বরং এক খেলোয়াড় কম আছে। ফিলিস্তিন যখনই তাজিকিস্তানের গোল-সীমানায় চড়াও হয়েছে তখনই ৯ তাজিক ফুটবলার ‘দেয়াল’ তৈরি করে তা সামাল দিয়েছে সুনিপুণভাবে। আর পাল্টা আক্রমণ করার সময় অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ওপরে উঠে গিয়ে বিপদে ফেলে দেয় ফিলিস্তিন-ডিফেন্ডারদের।
দু’দলই গোল করার একাধিক সুযোগ সৃষ্টি ও নষ্ট করে। তবে তাজিকদের আক্ষেপÑ তাদের একটি গোল অফসাইডের অজুহাতে বাতিল করে দেন বাংলাদেশের রেফারি মিজানুর রহমান। দশজন নিয়েও ‘তাজিক-ম্যাজিক’ হতে পারেনি টাইব্রেকার ব্যর্থতায়।
এক খেলোয়াড় কম নিয়েও তাজিকদের বল নিয়ন্ত্রণ ছিল অবিশ্বাস্যভাবে ফিলিস্তিনের চেয়ে বেশি (৫১%-৪৯%)। তবে আক্রমণে (৮৪-৬৬), বিপজ্জনক আক্রমণে (৫৭-৪২), কর্নারে (৮-৩) এবং শট অন টার্গেটে (৯-৩)… সবকিছুতেই এগিয়ে ছিল ফিলিস্তিন। কিন্তু আসল কাজের কাজ ‘গোল’ই করতে পারেনি তারা। নির্ধারিত ৯০ মিনিট এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিট… মোট ১২০ মিনিটেও কোন দল গোল করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ম্যাচ গড়ায় ‘টাইব্রেকার’ নামক ভাগ্যপরীক্ষায়।
তাজিকিস্তানের হয়ে গোল করেন আবদুগাভারভ, নাজারভ আখতাম এবং আসররভ সিয়োভুশ। ফিলিস্তিনের হয়ে গোল করেন জোনাথন জরিল্লা, মাহমুদ আলিউয়িসাত, মুসাব বাতাত এবং আবদাল লতিফ। তাজিকিস্তানের গোল মিস করেন তুরসুনভ কমরন (মাত্র ২ গোল করে এ আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই!) এবং তাবরেজি ভ­াতিমির। দু’জনের শটই ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেকিয়ে দেন ফিলিস্তিন গোলরক্ষক রামি হামাদা। শেষ পর্যন্ত জয়ের নায়ক বনে যান তিনিই। ম্যাচসেরার পুরস্কার লাভ করেন তিনিই।
সেরা খেলোয়াড় হন বিজয়ী দলের অধিনায়ক আব্দাল লতিফ। বিজয়ী ও রানার্সআপ দল লাভ করে যথাক্রমে ৫০ হাজার এবং ২৫ হাজার ডলার।
হেড টু হেড লড়াইয়ে দু’দল এ পর্যন্ত চারবার মুখোমুখি হয়েছে। তাতে জয়ের পাল্লা ভারি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ফিলিস্তিনের। তারা জিতেছে ২টি ম্যাচে। মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তানের কোন জয় নেই। বাকি দুটি ম্যাচ ড্র হয়। গোলের ব্যবধানেও এগিয়ে রয়েছে ফিলিস্তিন। তাদের ৬ গোলের বিপরীতে তাজিকিস্তান করেছে ৪ গোল। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়েও এগিয়ে ফিলিস্তিন। তাদের র‌্যাঙ্কিং ১০০। আর তাজিকিস্তানের ১২০।
শিরোপা সংখ্যায়ও এগিয়ে ফিলিস্তিন। তারা এ পর্যন্ত জিতেছে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ, এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ আর নাগমা কাপ ট্রফি। আর তাজিকরা জিতেছে ১টি, এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ।
বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের পঞ্চম আসরে দু’দলই খেলেছে প্রথমবারের মতো। তাজিকরা তাদের প্রথম ম্যাচে নেপালকে ২-০ গোলে হারিয়ে শুভসূচনা করলেও পরের একই ব্যবধানে হেরে হোঁচট খায় ফিলিস্তিনের কাছে হেরে। গ্রুপ রানার্সআপ (‘এ’ গ্রুপ) হয়ে তারা পা রাখে শেষ চারে। সেখানে ফিলিপিন্সকে ২-০ গোলে হারিয়ে নিশ্চিত করে ফাইনাল খেলা।
পক্ষান্তরে তাজিকিস্তানকে ২-০ গোলে হারিয়ে যাত্রা শুরু করা ফিলিস্তিন দল পরের ম্যাচেও জয়ের ধারা অব্যাহত রাখে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন নেপালকে ১-০ গোলে হারিয়ে। গ্রুপসেরা হয়ে নাম লেখায় সেমিফাইনালে। সেখানে তারা ২-০ গোলে স্বাগতিক বাংলাদেশকে হারিয়ে পা রাখে স্বপ্নের ফাইনালে।
সোনালী প্রলেপে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ২৭ ইঞ্চি লম্বা ট্রফিটি ফিলিস্তিন দলের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।