সমস্যায় জর্জরিত সৌদি প্রবাসীরা দিশেহারা

60

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কর্মসংস্থানের অভাব, অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত সৌদি প্রবাসীরা এখন দিশেহারা। বৈধ-অবৈধ কেউই স্বস্তিতে নেই। ইকামাবিহীন অনেকে পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। নতুন আসা অনেকে মরুভূমিতে তাঁবু টানিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। কর্মহীন এসব প্রবাসীদের চোখে এখন কেবলই কান্না।
সৌদি আরবে অর্থনৈতিক মন্দায় একের পর এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ও অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা করতে সৌদি সরকার একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু তাতে খুব একটা সুফল তো পাওয়া যাচ্ছেই না উল্টো এর প্রভাব প্রবাসীদের মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিক অবস্থা চাঙ্গা করতে প্রবাসীদের অভিবাসন ব্যয় বাড়িয়েছে সৌদি সরকার। গত কয়েক মাসে কয়েক দফায় প্রবাসীদের জন্য প্রায় ৩৬টি কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে প্রবাসীদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে। কাজের অভাবে অনেক প্রবাসী সৌদি ছেড়ে নিজ দেশে চলে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
অনেকে বলছেন দেশ থেকে প্রবাসী হটাতে এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সৌদি সরকার।
কয়েক বছর ধরে সৌদিতে এই অবস্থা বিরাজ করলেও বর্তমানে তা চরম সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান এমন কোনো লক্ষণ দেখছেন না প্রবাসীরা। তাই চরম হতাশায় দিন কাটছে তাদের।
কাজ না পেয়ে হতাশায় ভুগতে ভুগতে বাংলাদেশিদের মধ্যে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে জমি বিক্রি ও সুদে টাকা সংগ্রহ করে যারা সৌদিতে এসেছেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে বেশি। কদিন পরপরই আত্মহত্যার খবর আসছে খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
সৌদিতে যারা নতুন আসছেন, কর্মহীনতার কারণে তাদের অনেকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। সম্প্রতি এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সৌদিতে এসেছেন নিজেদের ও পরিবারের দুঃখ্ গোছাতে।
কিন্তু এখন উল্টো দুঃখের মরুভূমিতে পড়েছেন তারা। দালালের মাধ্যমে একেকজন সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়ে সৌদি এসেছেন, কিন্তু কোনো কাজ পাচ্ছেন না। মাসের পর মাস বেকার থেকে বাসা ভাড়ার টাকা নেই তাদের। একপর্যায়ে দালালরা মরুভূমিতে তাঁবু টানিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সপ্তাহে দুই বা তিন দিন একবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাও সামান্য শুকনো রুটি। বাকি সময় তারা রাস্তার পাশে ডাস্টবিনের খাবার খেয়ে জীবনধারণ করেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
দিনের বেলা প্রখর সূর্যতাপ থেকে বাঁচতে মরুভূমি ছেড়ে রাস্তার পাশে খেজুরগাছের ছায়ায় আশ্রয় নেন এসব অভিবাসী। আবার রাতের বেলা তীব্র শীতে জবুথবু হয়ে থাকেন। এই অবস্থায় টিকতে না পেরে তাদের অনেকে দালালকে বলেছিল দেশে পাঠিয়ে দিতে, কিন্তু সে জন্য দালাল মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। তাই তারা দেশে ফিরে যেতেও পারছেন না।
নিজেদের দুর্দশার কথা বলার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বসির আহমেদ অঝরে কাঁদছিলেন।  মক্কায় বসির ও তার কয়েক বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, কাবার হেরেমের আশপাশে ঘোরাঘুরি করলে লোকে মাঝেমধ্যে খাবার দেয়। তাই আপাতত জীবন বাঁচানোর স্বার্থে কিছুদিন মক্কায় হেরেমের আশপাশে থাকা যায় কি না সেই চেষ্টা করছেন  তারা।
প্রবাসীদের মধ্যে যারা পুরনো, তারাও যে সুখে আছেন তা নয়। অনেকে দেশে ফেরার জন্য টাকা পান না। তাই ইচ্ছা করে পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে দেশে যাচ্ছেন তারা। সেটাও একেবারে নির্বিঘ্ন নয়। যাদের বৈধ ইকামা (রেসিডেন্ট পারমিট) আছে, তারা চাইলেও ইকামার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশে ধরা দিতে পারছেন না। কেননা ইকামার মেয়াদ থাকলে কাউকে পুলিশ ধরে না।
কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ঘোষঘর গ্রামের মান্নান ভূইয়ার ছেলে সুমন। তিনি মোটে বছর খানেক হলো সৌদি আরব এসেছেন। কিন্তু বর্তমানে কাজ না থাকায় তিনি দেশে ফিরে যাবেন। ইকামারও মেয়াদ শেষ। সেই হিসেবে পুলিশে ধরা দিলে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু কয়েকবার তিনি পুলিশে ধরা দিলেও তাকে দেশে না পাঠিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অবশেষে এক পরিচিতের মাধ্যমে ১৫০০ রিয়াল (৩০ হাজার টাকা)  পুলিশকে ঘুষ দিয়ে তিনি সফল হন।
তবে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সামান্য ছুতোনাতায় বৈধ লোককে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার নজিরও আছে।
এর মধ্যে আবার ইকামা বিড়ম্বনা ছাড়ছে না নতুনদের। যারা সৌদিতে নতুন আসছেন তাদের অনেকেই সহজে ইকামা পাচ্ছেন না। দালালরা ইকামা দিতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছেন। মাসের পর মাস এমনকি বছর পেরিয়ে যায় কিন্তু ইকামা মেলে না। আর কাজ? সে তো সোনার হরিন এখন। ইকামা ছাড়া কোনো কাজে যোগ দেয়া যায় না। তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পুলিশের ভয়ে তারা ঘরে বন্দিজীবন কাটায়, অথবা রাস্তায় বের হলে লুকিয়ে চলাফেরা করে। পুলিশি ভীতি নিয়ে ফেরারি আসামির মতো দিন যাপন করতে হয় ইকামা না পাওয়াদের।
এমনই একজন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার হাটাস গ্রামের যুবক আরিয়ান আহমেদ নাজির। ৮ লাখ টাকা দিয়ে তিনি ১০ মাস আগে সৌদি আরব আসেন। কিন্তু এখনো ইকামা পাননি। যিনি তাকে এখানে এনেছেন তার সঙ্গে প্রায়ই মনোমালিন্য বা বাগবিতণ্ডা হয়। ইকামা না থাকায় নাজিরকে ইতোমধ্যে একবার পুলিশ আটক করেছিল। এক দিন অনাহার অবস্থায় জেল খাটানোর পর ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে তাকে মুক্তি দেয়।
নাজির বলেন, ‘এ রকম আর দু-একবার ধরা পড়লে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তখন আমার ৮ লাখ টাকার কী হবে!’
প্রবাসীদের এসব সমস্যা সমাধানের জন্য গত জানুয়ারির মাঝামাঝি সৌদি সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। কিন্তু সেই চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় প্রবাসীরা আরও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। তারা এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।