গ্রেনেড হামলা মামলার রায় আগষ্টে হতে পারে

52

কাজিরবাজার ডেস্ক :
১৪ বছর আগে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার বিচার শেষ হতে যাচ্ছে নিম্ন আদালতে। বিচারিক আদালতে সহসাই রায়ের তারিখ ঘোষণা হতে পারে। আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হামলার মাস আগস্টেই আসতে পারে রায়।
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের পর বিপাকে পড়া বিএনপির জন্য এই হামলার রায় সুখকর নাও হতে পারে। কারণ, দুর্নীতির দায়ে ১৭ বছরের কারাদণ্ড হওয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান এই মামলার আসামি। আর তার মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
তারেক রহমান ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টু, তার ভাই মাওলানা, তাজউদ্দিন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, এই মামলার আসামি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আরেক মন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের নাম এই মামলা থেকে বাদ গেছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তার ফাঁসি হওয়ায়।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ‘মামলায় মোট ৪৫ জনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করার কথা। এরই মধ্যে ৪৩ জনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। আর দুই আসামির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন বাকি আছে।’
এখন এই মামলায় বিএনপি-জামায়াত সরকারের উপমন্ত্রী পিন্টুর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন চলছে। এরপর যুক্তি দেবেন বাবরের আইনজীবীরা। আগামী ২৩, ২৪ ও ২৫ জুলাই এই যুক্তি উপস্থাপনের জন্য সময় নির্ধারিত আছে।
বাবরের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ পাবে। এরপর ঘোষণা করা হবে রায়ের তারিখ।
গত বছরের ২৩ অক্টোবর থেকে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয় এ মামলায়। গত ১ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর শুরু হয় আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন।
এই মামলায় সব মিলিয়ে ৫২ জন আসামি ছিলেন। এদের মধ্যে জামায়াত নেতা মুজাহিদ ছাড়াও হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান এবং শরীফ সাইদুল আলম বিপুলের ফাঁসি হয়েছে অন্য মামলায়।
আর এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে চলা দুটি মামলা একসঙ্গেই চলছে আর চারজন দুই মামলারই আসামি। এই হিসাবে যুক্তি উপস্থাপন হবে ৪৫ জনের।
রায় ঘোষণায় আর কত দিন সময় লাগতে পারে- জানতে চাইলে সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ‘আসামিপক্ষ মামলায় সময়ক্ষেপণ করছে। তবে এখন শেষ হতে আর বেশি সময় লাগবে না।’
পুরান ঢাকায় ১নং অস্থায়ী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার বিচার কাজ চলছে।
নজিরবিহীন হামলা : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস ঘটনা ঘটে। প্রকাশ্য জনসভায় নজিরবিহীন হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ নেতা-কর্মী আহত হন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ছোড়া গ্রেনেড থেকে নেতারা তাকে রক্ষা করেন মানববর্ম বানিয়ে। নেত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন দেন তার একজন দেহরক্ষী।
ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে থানা পুলিশ। পরে তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরবর্তীতে মামলাটি যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)।
তদন্তের শুরুতে জোট সরকারের ‘অপচেষ্টা’ : শুরু থেকেই এই হামলার জন্য সে সময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপির সম্পৃক্ততার অভিযোগ করে আসছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ওই আমলে সরকার মামলাটি ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তখন সরকারের বিরুদ্ধে মামলার আলামত ইচ্ছা করেই নষ্ট করার অভিযোগ উঠে। সে সময়ের জোট সরকার যুক্তরাজ্যের তদন্ত সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে তদন্তের জন্য আমন্ত্রণ জানালেও তারা সরকারের অসহযোগিতায় বিরক্তি প্রকাশ করে চলে যায়।
পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তদন্তের জট খুলতে শুরু করে। সে সময় জজ মিয়া নামে নিরীহ একজনকে আসামি সাজিয়ে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা ফাঁস হয়ে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।
২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি। এতে শেষে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুর সালাম মিণ্টু ও তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনকে আসামি করা হয়।
ওই বছর ২৯ অক্টোবর ২২ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। ২০০৯ সালের ৯ জুন পর্যন্ত ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।
অধিকতর তদন্তে আসামি তারেক : ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। পরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আখন্দ।
২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নতুন তালিকাভুক্ত ৩০ আসামির অভিযোগ গঠন করে ফের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
অর্থাৎ প্রকাশ্যে ঘটা এই ঘটনার বিচার শুরু হতেই লেগে যায় প্রায় চার বছর। আর আরও সাড়ে নয় বছর শুনানি চলার পর শুরু হয় যুক্তি উপস্থাপন।
তবে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হওয়ার পর বেশ গতি পেয়েছে মামলাটি।
তারেকসহ সবার মৃত্যুদণ্ড দাবি : রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রেজাউর রহমান বলেন, ‘আমরা আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।’
যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রপক্ষ ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক, বিভিন্ন সরকারি ও প্রশাসনিক সহযোগিতার তথ্য-প্রমাণ পেশ করে। তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় বনানীর হাওয়া ভবন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সরকারি বাসভবনসহ ষড়যন্ত্রমূলক সভার স্থানসমূহ তথ্য-প্রমাণের আলোকে তুলে ধরা হয়।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ২২৫ জন সাক্ষী (পিডব্লিউ) ও আসামিপক্ষে ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য (ডিডব্লিউ) পর্যালোচনা করে আদালতে যুক্তিতর্ক পেশ করে।
তারেক রহমানসহ পলাতক ১৮ আসামির পক্ষে এই মামলায় যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সরকার নিযুক্ত আইনজীবী। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন আইনজীবী আবুল কালাম মো. আকতার। তিনি তারেকের খালাস দাবি করেছেন।
পলাতক যারা : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল এটিএম আমিন আহমদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ, পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান পলাতক রয়েছেন।
এছাড়াও জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মাওলানা তাজ উদ্দিন, মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিন, মোহাম্মদ খলিল, জাহাঙ্গির আলম বদর, ইকবাল, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ লোকমান হাওলাদার, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের, মুফতি শফিকুর রহমান, রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবুকেও গ্রেপ্তার করা যায়নি।
এদের মধ্যে দুই আনিসুল মোরসালিন ও মহিবুল মুত্তাকিন ভারতের তিহার কারাগারে আটক রয়েছেন।
কারাগারে যারা
গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এরর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, বিএনপি নেতা লুৎফজ্জমান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুলস সালাম পিন্টু বিচার শুরুর আগে থেকেই কারাগারে।
জঙ্গি সদস্য শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, শেখ আবদুস সালাম, আবদুল মাজেদ ভাট, ইউছুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা ওরফে জিএম, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর ওরফে আবু হুমাইয়া ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমেদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিব উল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সায়ীদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গির আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামীম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে খাজা ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, আবিদ হাসান সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামীম ওরফে রাশেদ, মো. উজ্জল ওরফে রতন ও হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়াও বন্দী আছেন।
যারা জামিনে : এই মামলায় জামিনে আছেন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক আইজিপি খোদাবক্স, সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ ও ঢাকা মহানগরীর ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ।