মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজারে মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হলেও নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে ভাটি এলাকা। বন্যা কবলিত এলাকায় ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট ও স্যানিটেশনের দুরবস্থা বিরাজ করছে। খোলা জায়গায় টয়লেট ও বানের পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়াসহ জটিল রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। একইসঙ্গে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকটও।
মৌলভীবাজারের বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখনও অনেক বাসাবাড়ি পানির নিচে রয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে প্লাবিত এলাকার মানুষজন ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে অথবা বাসাবাড়ির ছাদে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন বাঁধে। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। তবে যারা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। বিশুদ্ধ পানি সংকট আর স্যানিটেশনের বিদ্যমান দুরবস্থায় রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা চললেও সংকট রয়েছে খাদ্যের। বানভাসী মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুর দুর্ভোগ ও দুর্দশাও চরম আকার ধারণ করেছে।
বারইকোনায় মনু নদীর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে লন্ডন প্রবাসী শাহাবুদ্দিনের বাড়ি। তার মামা ইসমাইল আলী বলেন, ‘শাহাবুদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে থাকে। মাঝেমধ্যে দেশে আসলে এই বাসায় থাকে। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সময় বাড়িতে কেউ ছিল না।’ বাঁধ ভাঙার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইঁদুর ও শেয়ালের গর্ত থাকায় প্রথমে চুইয়ে চুইয়ে পানি বের হতে থাকে। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে প্রবল বেগে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। অনেকে বাসাবাড়িতে মালামাল রেখে জান বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেন।’
বড়হাট বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে প্রায় চারশত পরিবার। সেখানে আশ্রয় নেওয়া লোকজন জানান, পানির সংকটে দিনের পর দিন গোসল করতে পারছেন না তারা। কাপড়-চোপড়ও নেই। খাবারেরও সংকট রয়েছে।
কলোনিতে বসবাসকারী বাবলী বেগম বলেন, ‘জান বাঁচাইয়া কোনোভাবে আমার বৃদ্ধা মা, জমজ দুই বাচ্ছাসহ মোট পাঁচজন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। পরিবারের একমাত্র রোজগারী আমি। আমার বাসায় কোমর পানি। সেলাই মেশিন পানির নিচে। আমার সেলাই মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে কী করে খাবো।’
পাশে ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নেওয়া শারমিন ও ইয়াছমিন জানান, মা-বাবাসহ পরিবারের মোট ছয় সদস্য ওই ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকছেন। তারা বলেন, ‘রাতে বাঁধ ভাঙছে। মানুষের হইহল্লা-চিৎকার শুনে কোনোমতে প্রাণ বাঁচাতে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। আগে থেকে টের পাইনি। হঠাৎ দেখি ঘরে পানি ঢুকছে। কোনোমভাবে হাতের কাছে যা পাইছি তা নিয়া এখানে আইছি।’
বড়হাটের শহর রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া সালেহা বেগম বলেন, ‘সোমবার পাঁচ কেজি চাউল পাইছি। চাউল পাওয়ায় ভাত খাইতে পারছি। না হইলে খাইতে পারতাম না। এখন সমস্যা একটা টয়লেট ও পানির। একটি টিউবওয়েল থেকে বাঁধের ওপর আশ্রয় নেওয়া প্রায় চারশত মানুষ পানি খাচ্ছে।’
মৌলভীবাজার শহরের বন্যাকবলিত এলাকার প্রতিটি বাসাবাড়িতে পৌরসভা থেকে দেওয়া বিশুদ্ধ পানির রিজার্ভারটি এখন কয়েক ফুট পানির নিচে। আর নলকূপের পানি ট্যাংকে রিজার্ভ রাখার ব্যবস্থাও এখন অচল। কারণ, বন্যাকবলিত শহর ও গ্রামের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। তাই খাওয়ার বিশুদ্ধ পানির যেমন চরম সংকট, তেমনি গোসল, রান্নাবান্না ও প্রয়োজনীয় কাজের ব্যবহারের জন্যও মিলছে না পানি।
শহরের বন্যাকবলিত তিনটি ওয়ার্ডের (৬, ৯ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড) প্রতিটি বাসার নিচতলায় রয়েছে বন্যার পানি । একতলার বাসিন্দারা বাসার ছাদে কিংবা অন্যান্য উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। শহর এবং গ্রামের বন্যাকবলিত অনেকেই বানের পানি ঠেলে পায়ে হেঁটে অথবা নৌকায় দূর-দূরান্ত থেকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করছেন।
স্থানীয়রা জানান, বন্যাকবলিত অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার পানি জেলার হাকালুকি ও কাউয়াদিঘি হাওরে গিয়ে পড়ায় এখন নতুন করে হাওর তীরবর্তী এলাকাও বন্যাকবলিত হচ্ছে। বানভাসী মানুষের অভিযোগ— সরকারের পক্ষ থেকে তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেন না। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং দেশ ও প্রবাসে থাকা অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। তারা রান্না করা খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওরস্যালাইন, মোমবাতি, ম্যাচ ও শুকনো খাবার বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করছেন।
মৌলভীবাজার পৌরসভার উদ্যোগে শহরের বন্যাকবলিতদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে রান্না করা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি। এছাড়া, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনগুলোও বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। বন্যার শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর একটি দল পুরো জেলায় বন্যাকবলিতদের উদ্ধার, নদীর ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিরক্ষা বাঁধ মেরামত ও ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।
মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘ এবারের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে । ১৯৮৪ সালে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল, সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে এবারের প্লাবন। আকস্মিক বন্যায় চোখের সামনেই সবকিছু তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে পৌর এলাকার বাসাবাড়িতে অনেকের ঘরে খাবারের উপকরণ থাকার পরও পানি ও বিদ্যুৎ না থাকায় তারা অর্ধাহারে অনাহারে দিনযাপন করছেন।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, ‘জেলার বন্যা পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হচ্ছে। উজান থেকে ঢলের পানি কম আসায় ও ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নতুন করে ভাঙার ঝুঁকি অনেকটাই কমছে।’ বাঁধ ভাঙার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নদীগুলো আঁকাবাকা। দীর্ঘদিন নদীগুলো ড্রেজিং না হওয়ার কারণে প্রচুর পলি জমেছে। পলি পড়ে নদীর ধারণ ক্ষমতা অন্তত ৬০ শতাংশ কমে গেছে। উজানে যখন কোনও ভারী ঢল হয়, তখন নদীগুলো প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।’
বাঁধ রক্ষার বরাদ্দের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিলাম। কিন্তু মাত্র দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। এই টাকা দিয়ে গত অর্থবছরে বন্যা মোকাবিলা করার জন্য যে টেন্ডার করেছিলাম, সেই টেন্ডারের বকেয়া পরিশোধ করতেই শেষ হয়ে গেছে।’
মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন ডা. আবু জাহের বলেন, ‘বন্যাকবলিতদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে জেলা জুড়ে ৭৪টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। সব জায়গায় মেডিক্যাল টিম পাবেন। তবে ডাক্তার সংকট থাকায় ‘টেকনো’ দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মেডিক্যাল টিম পরিচালনা করা হচ্ছে। তারা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওরস্যালাইনসহ প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ দিচ্ছেন এবং পানিবাহিত নানা রোগবালাই থেকে নিরাপদ থাকতে বন্যাকবলিতদের পরামর্শও দিচ্ছেন।’ মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, ১৩ জুন থেকে জেলায় মনু ও ধলাই নদীর পানি রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট বন্যায় প্রতিরক্ষা বাঁধের ২৫টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত এই জেলায় ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ৫ হাজার ৩৯০ জনকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। মৌলভীবাজার সদরে ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এছাড়া, বেসরকারি উদ্যোগে আরও কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যেখানে বিএনসিসি স্কাউটসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে খিচুরি রান্না করে বিতরণ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর চারটি টিম বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ করছে। তারা পানিবন্দিদের উদ্ধারের কাজে ১৮টি স্পিডবোট ব্যবহার করছে। নগদ ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা, ৭৪৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। মজুদ আছে ১ হাজার ৩৭ মেট্রিক টন চাল। আরও ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ৩ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেটের আশ্বাস মিলেছে। শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবির ৪টি গাড়ি টহল দিচ্ছে। সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে ৭৪টি মেডিক্যাল টিম বন্যাকবলিত এলাকায় কাজ করছে।