কাজিরবাজার ডেস্ক :
হাজার মাসের চাইতে যে রাত মহামূল্যবান/ শবে ক্বদর সেই যে সে রাত/ শোন মুসলমান।/আজ সে মহামূল্যবান বরকতময় রজনী পবিত্র শবে ক্বদর বা লাইলাতুল ক্বদর। রমজানের লাইলাতুল ক্বদর মুসলিম জীবনে এক অতি পুণ্যময় ও অনন্য রজনী। যে পাঁচটি রাতকে মহান আল্লাহ পাক অফুরন্ত বরকত প্রদান করেছেন, তন্মধ্যে লাইলাতুল ক্বদর এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। বিশেষত এ রজনী হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে সুরা কদরে উল্লেখ করা হয়েছে। এ রাতের ফজিলত ও মহাত্ম্য সম্বন্ধে হযরত সালমান হতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, মহানবী (স.) শাবান মাসের সমাপনী দিবসে আমাদের নসিহত করেন এবং বলতেন, তোমাদের মাথার ওপর এমন এক মর্যাদাশালী মোবারক মাস ছায়াপাত করেছে যার মাঝে রয়েছে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ মানে একটি রাতÑ যা হাজার মাস হতেও উত্তম। আজ দিনের অবসানে আমাদের সামনে সে মহিমান্বিত রজনী।
হযরত ইবনে আবী হাতিম সূত্র পরস্পরায় হযরত মুজাহিদ (রহ:) থেকে উদ্ধৃত করেন যে, একবার নবী-ই-দোজাহান (স.) সাহাবাদের কাছে বনি ইসরাঈলের এক দরবেশের কথা বলেন। উক্ত দরবেশ একাধারে এক হাজার মাস পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত ছিলেন। এ ঘটনা শুনে উপস্থিত মুসলমানরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। এমনিভাবে হযরত জরীরও হযরত মুজাহিদের (রহ:) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বনী ইসরাঈল যুগে জনৈক দরবেশ হাজার মাস ধরে সারাটা রাত ইবাদত বন্দেগি করতেন আর পুরোদিন লড়তেন শত্র“দের মোকাবিলায়। হযরত ইবনে আবী হাতিমের অপর এক বর্ণনা মতে, বনি ইসরাঈলের মধ্যে ৪ জন ইবাদত গুজার ব্যক্তি ছিলেন। তারা প্রত্যেকে ৮০ বছর যাবৎ আল্লাহর ইবাদতে সর্বক্ষণ মশগুল থাকতেন। ওই ৪ জন আবিদ হলেন হযরত আইয়্যুব, জাকারিয়া, হিজকিল ও ইউশা বিন নুন। এ ঘটনা শোনার পর উপস্থিত সাহাবাগণ বিস্মিত হয়ে পড়েন। ঠিক তখনই হযরত জিবরাঈল (আ.) এসে আরজ করেন : হে নবীকুল সম্রাট মুহম্মদ (স:)! আপনার উম্মতরা বনি ইসরাঈলের আবিদদের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কিন্তু মহান প্রভু আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সেটা অপেক্ষা উত্তম বস্তু আপনাকে দান করেছেন। তখন সুরা কদর নাজিল হয়।
এতে মহানবী (স.) ও তার সাহাবা-ই-কেরাম অভূতপূর্ব আনন্দে ফেটে পড়েন। সুরা ক্বদরে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন : অবশ্যই আমরা (আমি) সেটা (কুরআন শরীফ) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। লাইলাতুল ক্বদর সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম। এতে রুহ ও তার ফেরেস্তারা তাদের প্রতিপালকের আদেশে প্রত্যেক কাজের জন্যে অবতীর্ণ হন। তা প্রভাত পর্যন্ত শান্তিময়। হযরত সুফিয়ান আস সোরির বর্ণনা মতে, বরকতওয়ালা এ রজনীর প্রতিটি নেক কাজ- রোজা, নফল ইবাদত হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদত বন্দেগির সমতুল্য।
কুরআন নাজিলের মহিমায় ভস্কর এ রাত রমজানের শেষ দশকে অবস্থিত বলে এটা মাগফিরাত বা গুনাহ মাফের দশক হিসেবে বিঘোষিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত বুখারী শরিফের হাদিস থেকে জানা যায় যে, হযরত রাসূলে মাকবুল (স.) রমজানের শেষ দশকে শক্ত করে কাপড় বেঁধে রাতভর জেগে ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন এবং তাঁর পরিবারকেও জাগাতেন। হযরত কাব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ৭ম আকাশে জান্নাতের অদূরে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক গাছের মাঝামাঝি হজরত জিবরাঈলের নিবাস। আবার উক্ত গাছের শাখা-প্রশাখায় বাস করেন অসংখ্য অগণিত ফেরেস্তা। মুমিনদের প্রতি স্নেহ পরায়ণ এ সব ফেরেস্তা জিবরাঈলের (আ.) নেতৃত্বে এ রাতে আলাহর নির্দেশ মুতাবেক সূর্যাস্তের পরপরই পৃথিবীতে অবতরণ করেন; ঘুরে বেড়ান পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। কিন্তু মুশরিক ‘জাদুকর’ নেশাখোর, জিনাকার, আত্মীয়ের প্রতি অনুদার প্রভৃতি খারাপ লোক এবং ময়লা আবর্জনাযুক্ত অপবিত্র স্থান থেকে দূরে থাকেন। পক্ষান্তরে মুমিনদের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করে সারা রাত দোয়া করতে থাকেন আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছাতে থাকেন ইবাদতে মশগুল সকল মুমিনের কাছে।
পরিতাপের সঙ্গে আমরা বারবার বলে থাকি যে, আজকের সমাজ হচ্ছে- কুসংস্কার ও অনৈতিকতার রমরমা বাজার। এ সুবাদে এ ধরনের বরকতময় রাত ও মাসগুলোতে আমরা অজ্ঞতা বশত বা কু সংস্কারজনিত কারণে এমন কতক কাজ করে বসি যা ইসলাম যেমন মোটেই সমর্থন করে না আর তেমন নয় কোন পুণ্য ধর্মের কাজ। এ ধরনের অযথা কাজকর্ম যেমন নিজের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে আর তেমনি সমাজে অন্যান্য মুমিন মুসলমান ভাবগম্ভীর পরিবেশে সময়টি কাটাতে চান তাদের ইবাদত-বন্দেগিতেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তদুপরি অপচয়ও বৈকি! যেমন আতশবাজি পটকা ফুটানো ইত্যাদি এ সকল কাজ সর্বোতভাবে পরিহার করা উচিত।
আল্লাহ পাক আমাদের এ মহামূল্যবান রজনীতে পূর্ণ গাম্ভীর্য সহকারে ইবাদত বন্দেগি করার তৌফিক দিন।
এদিকে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যময় পরিবেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সারাদেশে পবিত্র শবে ক্বদর পালন করবে। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।