কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহান আল্লাহর রহমতে আমরা এখন মাহে রমজানের ৩য় দশকে। আজ ২১ রমজান। গত রাত থেকে শুরু হলো ইতেকাফ সাধনা। নবীজী হাদিস শরিফে বলেছেন, মাহে রমজানের ১ম দশক রহমতের, ২য় দশক মাগফিরাতের আর সমাপনী দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তির। অর্থাৎ মাহে রমজান বিশ্বব্যাপী এক একতা ও ভ্রাতৃত্বের জয়গান করার সামিয়ানা আমাদের আকাশে টানিয়ে দিয়েছে। যা আজকের বিশ্বের শান্তি শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রধানতম নিয়ামক শক্তি। একতা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন : কুনতুম খাইরা উম্মাহ উখরিজাত লিন্নাস… তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, তোমাদের মানব কল্যাণের জন্য আবির্ভূত করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজে আদেশ দেবে অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে…। আমাদের মহানবী হজরত মুহম্মদ (স.) হাদিস শরিফে বলেছেন: তুমি মুমিনগণকে পারস্পরিক করুণা প্রদর্শন, পারস্পরিক প্রেম ভালবাসা এবং পারস্পরিক সহানুভূতি প্রদর্শনের দিক দিয়ে একই দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। যখন দেহের কোন একটি অঙ্গ কষ্ট অনুভব করে, তখন গোটা দেহটাই জ্বর ও নিদ্রাহীনতা দ্বারা এর প্রতি সাড়া দিয়ে থাকে। (বুখারী, মুসলিম)।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মাপকাঠিতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : আশিদ্দাউ আলাল কুফ্ফার রুহামাউ বায়নাহুমÑ মুসলিম জাতি বিদ্রোহীদের ব্যাপারে বজ্র কঠিন এবং পরস্পর সহানুভূতি পরায়ণ। অন্যত্র তিনি বলেছেন : তায়ালাউ ইলা কালিমাতিন সিওয়াইন বাইনানা ওয়া বাইনাকুম…। অর্থাৎ এসো আমরা একতার স্বার্থে কতিপয় বিষয়ে পারস্পরিক ঐকমত্য পোষণ করি…। এসব মূলনীতির মাধ্যমে আমরা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও একটি রূপরেখা অনুধাবন করতে পারি।
আরবিতে ভ্রাতৃত্বকে বলা হয় মুয়াখাত। ইসলামের ইতিহাসে এটি রীতিমতো একটি পরিভাষাও বটে। তবে বিস্মিত পরিভাষা, আজকের মুসলিম বিশ্ব ভুলে যাওয়া পরিভাষা। আজ মুসলিম ব্যক্তি পরস্পরে, সমাজ অভ্যন্তরে কিংবা মুসলিম দেশগুলোর মাঝে কোন ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয় তো নেই বরং পরস্পর না বিশ্বাস, ভ্রাতৃঘাতী কলহ এবং অন্যের প্ররোচণায় উম্মাহর চিন্তা-চেতনাকে ধ্বংস করার এক হীন ও ভ্রান্ত মন-মানসিকতার ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। অথচ মুসলিম সমাজে এখনও যে মেধা ও সম্পদ রয়েছে তা যদি মিলমিলাপ এবং ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে ব্যবহৃত হতো প্রতিটি মুসলিম সমাজ আজও সমৃদ্ধি ও শান্তির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারত। যেমনটি ছিল মহানবীর যুগের আদর্শ সমাজ। সমাজ সংস্কার ও সমাজ সুন্দরে মহানবী হুজুরে পুর নূর (স.) যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এর মধ্যে দ্বীনি মুয়াখাত প্রতিষ্ঠা ছিল একটি। মহানবী চিন্তা করেছিলেন, সবকিছু আইন করে নয়, বরং মানসিক পরিবর্তন এনে, পরস্পর সহানুভূতি-সহমর্মিতার শিক্ষা দিয়েও সমাজের অভূতপূর্ব কল্যাণের কাজে হাত দেয়া যায়। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেছিলেন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের এক বুকভরা আশা নিয়ে। কিন্তু এ সিপাহসালার যেসব জিন্দাদিল সাহাবীদের নিয়ে এ মিশন প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়েছিলেন হিজরতকালীন সময়ে সবাই সমস্ত ধন-সম্পত্তি রেখে কোন মতে দেহটা নিয়ে মদিনায় পৌঁছতে সক্ষম হন। মদিনায় গিয়ে মহানবীকে সাহাবীদের এ নিঃস্ব অবস্থাটা বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়। অবশ্য তিনি হিজরতের প্রস্তুতিকালেও বাইয়াতে আকাবার বৈঠকগুলোতে এ ব্যাপারে মতবিনিময় করেছিলেন। তখন মদিনার নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধিরা মহানবী ও তার মুহাজির সাহাবীদের প্রাণ উজাড় করা ভালোবাসা দেবে বলে আশ্বস্ত করেছিল।
হিজরত করার পর মহানবী দেখলেন মদিনার বেশকিছু নও মুসলিম বিশেষত মুহাজিরদের থাকা-খাওয়ার সমস্যা প্রখর। তিনি ধনীদের এ ব্যাপারে ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তার আহ্বানে অভাবিতপূর্ণ সাড়া পড়ে যায়। তিনি ধনীদের সঙ্গে গরীবদের, আনসারদের সঙ্গে মুহাজিরদের সুনির্দিষ্ট ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। ফলে দেখা গেল, তিনি সমাজের আবাসন সমস্যা সমাধানে এবং সহায়-সম্বলহীন মানুষদের পুনর্বাসনে খুব দ্রুত সফলতা অর্জন করেন।
যেমন সুহাইব ইবনে সিনান রুমীর (রা.) ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয় হারিস ইবনে সাম্মা আনসারীর সঙ্গে। মদিনা জীবনের শুরুতে আঁ- হযরত (স.) নিজের একটি হাত আলীর (রা.) কাঁধে রেখে বলেছিলেন: আলী তুমি আমার ভাই। তুমি হবে আমার এবং আমি হবো তোমার উত্তরাধিকারী।
সমাজের প্রতিটি নাগরিকের মাঝে যদি এমন মূল্যবোধের সৃষ্টি হয় তাহলে অবশ্যই সে সমাজে পরস্পর হিংসা থাকতে পারে না, অবিশ্বাস থাকতে পারে না, থাকতে পারে না কোন ধরনের নিরাপত্তাহীনতা। নিরাপদ ও আদর্শ সমাজের জন্য মুয়াখাত বা পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের এ ঐতিহাসিক দর্শন আমাদের স্বনির্ভর জীবন গড়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মাহে রমজান যেন মুসলিম জাতির মাঝে সেই হারানো ভ্রাতৃত্বের মুক্তমালা আবার গলায় ধারণ করার দীক্ষা দান করে।