কাজিরবাজার ডেস্ক :
চার বছরের মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছার কারণে বিশ্বজুড়ে কৃষকরা চাষাবাদ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধিতে সংকটের মুখে পড়ছেন। উৎপাদিত ফসলের দাম কমে যাওয়ার কারণে ইতোমধ্যে দুর্ভোগে থাকা কৃষকরা নতুন এই সংকটের কারণে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে যাচ্ছেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে একথা জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশিয়ায়, ব্রাজিল থেকে ইউরোপে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে লোকসানের মুখে পড়ছে কৃষি খাত। বৃহস্পতিবার ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো ডিজেলের মূল্য প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারে পৌঁছেছে। দেশীয় অর্থনীতির সংকটের পাশাপাশি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বজুড়ে কৃষকরা কৃষিখাতে ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন। যা এই খাতে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ হুমকির মুখে ফেলছে।
যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকদের ফসল উৎপাদনে খরচ বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। গম, ভুট্টা ও সয়াবিনের মতো ফসল উৎপাদনকারীরা ফসলের মূল্য কমে যাওয়াতে এমনিতেই ক্ষতির মুখে আছেন। এমন সময় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে যখন ২০১৩ সালের পর কৃষিখাতের আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে।
কৃষকদের ফসল রোপণ, উৎপাদন ও পরিবহনে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল একেবারে প্রয়োজনীয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষকরা আনুমানিক ১৫.১৫ বিলিয়ন ডলার জ্বালানি ও তেলের পেছনে ব্যয় করবেন। ২০১৭ সালের তুলনায় তা ৮ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছে দেশটির কৃষি মন্ত্রণলায়।
কৃষিতে ব্যবহৃত কম সালফারযুক্ত ডিজেলের মূল্য ২০১৪ সালের মে মাসের পর এতো বেশি বৃদ্ধি পায়নি। বৃহস্পতিবার কম সালফারের ডিজেলের প্রতি গ্যালনের মূল্য ছিল ২.২৯ ডলার।
আইওয়ার পেরিতে সয়াবিন চাষকারী রন হেক জানান, বসন্তে জ্বালানি তেলের দাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে। তিনি বলেন, ‘তখন সংকটটা আরও বেশি হবে।’
রাশিয়াতে এক বছর আগের তুলনায় কৃষকদের জ্বালানির মূল্য বেড়েছে ৫০ শতাংশ। রয়টার্সকে এই তথ্য জানিয়েছেন রাশিয়ার শস্য ইউনিয়নের প্রধান আরকাদি জ্লোচেভস্কি। তিনি জানান, আগামী মাসে রাশিয়ায় শস্য উৎপাদন শুরু হবে। আগের চেয়ে এবার কৃষকদের ফসল উৎপাদনে ব্যয় বেশি করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকরা চীনের শুল্কারোপের কারণে সম্ভাব্য লোকসানের মুখে রয়েছেন। চীন থেকে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র শুল্কারোপের পর বেইজিংও পাল্টা ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে।
মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি, খাদ্য ও খনিজসম্পদ বিভাগের পরিচালক স্কট ব্রাউন বলেন, এক দশকের মধ্যে কৃষিখাতে যে ধরনের আর্থিক সংকট আমরা দেখিনি তা হয়ত এবার আমরা প্রত্যক্ষ করব। যদি ডিজেলের মূল্য বাড়তেই থাকে তাহলে তা কৃষকদের আরও চাপে ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি আয় ৫৯.৫ বিলিয়ন ডলার প্রাক্কলন করা হয়েছে। যা ২০১৭ সালের তুলনায় ৮.৩ শতাংশ কম। আর ২০১৩ সালের তুলনায় তা ৫৫ শতাংশ কম।
আরকানসাসের টিম গ্র্যানন জানান, ফেব্রুয়ারি মাসে ৭ হাজার ৫০০ গ্যালন ট্যাংক ডিজেলের জন্য তিনি ব্যয় করেছেন ১৭ হাজার ডলার। সেচ ও কৃষি যন্ত্রপাতি পরিচালনায় এই ব্যয় হয়েছে তার। ডিজেলের ২৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে আগামী দিনগুলোতে জ্বালানির জন্য তাকে অতিরিক্ত ৪ হাজার ডলার ব্যয় করতে হবে। তিনি বলেন, ‘এটা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় লোকসান।’
এই কৃষক জানান, আগের লোকসান মোকাবিলা করতে এরই মধ্যে তিনি গত বছরের তুলনায় কম ডিজেল ব্যবহার করছিলেন। এবার আরও কমিয়ে দিতে হবে।
ব্রাজিলের কৃষকরাও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। ২০১৭ সালের তুলনায় দেশটিতে ডিজেলের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। মাতো গ্রোসো রাজ্যের কৃষক এদের ফেরেইরা বুয়েনো জানান, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে এই খাতে খরচ কমানো ছাড়া তার আর কোনও উপায় নেই। অন্য কৃষকরা হয়ত কম লোক নিয়োগ দেবেন বা বিনিয়োগের পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখছেন।
সয়াবিন খাবার ও তেলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ব্রাজিলের প্রতিবেশী আর্জেন্টিনা। দেশটিতে কৃষকরা যখন মুদ্রার মান কমে যাওয়া নিয়ে সংকটে আছেন ঠিক তখনই জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আর্জেন্টিনার গম খাতের চেম্বার আর্জেন্ট্রিগোর সভাপতি ও বুয়েন্স আইরেসের কৃষক ডেভিড হফ জানান, সবচেয়ে প্রভাব পড়বে পরিবহন ব্যয়ে। বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বিদের তুলনায় আমরা পিছিয়ে পড়ব।
ইউরোপের ফ্রান্সেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফসল উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। কৃষকদের সার ও ফসল রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যেও প্রভাব পড়বে। প্যারিসের ফসল উৎপাদনকারী গোষ্ঠী এজিপিবি’র প্রধান ফিলিপ পিনতা বলেন, অর্থনৈতিকভাবে কঠিন সময় যখন কৃষকরা পার করছেন তখন জ্বালানির দাম বাড়ছে।