কাজিরবাজার ডেস্ক :
নানা অপরাধে অভিযুক্ত ৮১ পলাতক বাংলাদেশির নাম ইন্টারপোলের তালিকায়। এর মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫৯ জনের নামে রেড নোটিশ জারি করে তালিকা তাদের ওয়েবসাইটে দিয়েছে ইন্টারপোল কর্তৃপক্ষ। বাকি ২২ জন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে নোটিশ জারির আবেদন জানায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।
এছাড়া পাঁচ বাংলাদেশি নিখোঁজ নাগরিককে খুঁজতে ইয়েলো নোটিশও আছে ইন্টারপোলের ওই তালিকায়। কিন্তু তাদের বিষয়ে খুব বেশি তথ্য সেখানে নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এর আগে বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে এমন তালিকাভুক্তদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলার অন্যতম প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনে বর্তমান সরকার। নূর হোসেন ভারতে গিয়ে গ্রেফতার হন। এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম আসামি পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নাজমুল মাকসুদ মুরাদকে। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপের মামলার আসামি মুরাদ। এখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রক্রিয়া চলছে।
তবে নানা জটিলতার কারণে বছরের পর বছর তালিকায় ঝুলে থাকা এসব অভিযুক্ত অপরাধীদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। পুলিশ সদর দফতর বলছে, ইন্টারপোলের (ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন) রেড নোটিশে থাকার পরও বিদেশে পলাতক আসামিদের দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া আটকে আছে নানা জটিলতায়। এজন্য সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। অথচ এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে দেশের বাইরে থেকেও বিভিন্ন চক্রান্তে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, কূটনীতিকভাবে আলাপ-আলোচনা করে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদ্যমান নিয়ম-কানুন মেনেই বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে পারে। তার মতে, আসামিদের ফেরতে একটি বড় বাধা সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকা বা সে দেশের আইন। তবে এরপরও কিছু ক্ষেত্রে আসামি প্রত্যর্পণের বিষয়টি নির্ভর করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সহেলী চৌধুরী বলেন, যে ব্যক্তিকে আমরা চাচ্ছি সেই ব্যক্তিকে রেড নোটিশের আওতায় আনার জন্য যা করা দরকার সে বিষয়ে কাজ করে থাকে পুলিশ। কিন্তু ওই আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই। এর সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থাও জড়িত। রেড নোটিশপ্রাপ্ত আসামিদের ফিরিয়ে আনা তাদেরই দায়িত্ব।
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নূর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরী, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি মাওলানা তাইজউদ্দিন ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীসহ ৮১ বাংলাদেশির নাম সংস্থাটির ওয়েবসাইটে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫৯ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি হয়েছে। এই ৫৯ জনের মধ্যে বিভিন্ন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি, যুদ্ধাপরাধীসহ শীর্ষ জঙ্গিদেরও নাম রয়েছে।
এছাড়া পলাতক যুদ্ধাপরাধী আবদুল জব্বার ও আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত সাত খুনি, তিন্নি হত্যার আসামি সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভির নামও রয়েছে। ইন্টারপোলের তালিকায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনের নাম ছিল। এরই মধ্যে নুর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে সরকার। ২১ আগস্ট হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামি তারেক রহমান এখনো লন্ডনে।
ইন্টারপোলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিচার বা দণ্ড ঘোষণার জন্য বাংলাদেশের বিচার কর্তৃপক্ষের কাছে ওয়ান্টেড ব্যক্তিরা পলাতক। রেড নোটিশের মাধ্যমে তাদের অবস্থান জানা এবং গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়। ওই ব্যক্তিরা যে দেশে দোষী সাব্যস্ত হয় সেই দেশে প্রত্যর্পণের সহায়তা করে ইন্টারপোল। দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দফতর ফ্রান্সে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্য পদ গ্রহণ করে। তবে পুলিশের আন্তর্জাতিক এ সংস্থার রেড নোটিশ কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা নয়। ইন্টারপোল আসামিকে গ্রেফতারে কোনো বাহিনী পাঠায় না বা কোনো দেশকে চাপও দিতে পারে না। তারা শুধু এ সংক্রান্ত তথ্য ১৯০টি সদস্য দেশকে জানায়।
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, ইন্টারপোল বাংলাদেশ শাখায় এখন পর্যন্ত ৮১ জনের নামে রেড নোটিশ জারি করা আছে। তারা হলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী আহমেদ হারিস, ওমর ফারুক কচি, আলম তাওফিক, কালা জাহাঙ্গীর ওরফে ফেরদৌস, ত্রিমতি সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ লোহানী, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, গোলাম ফারুক অভি, মিন্টু, আতাউর রহমান, জাফর আহমেদ ওরফে মানিক, খন্দকার তানভিরুল ইসলাম জয়, জিসান, নবী হোসেন, নাসির উদ্দিন রতন, শামীম আহমেদ ওরফে আগা শামীম, নজরুল দিপু, প্রশান্ত সরদার, আহমেদ মজনু, আবদুল জব্বার, ইউসুফ, আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, চাঁন মিয়া, শাহাদাত হোসাইন, খোরশেদ আলম, মনোতোষ বসাক, সুজিদ সুলতান, মোবারক হোসেন, ইকরাম নাইম খান, আহমদ কবির ওরফে সুরত আলম, জিসান, সালাহউদ্দিন মিন্টু, নবী হোসেন, আতাউর রহমান মাহমুদ চৌধুরী, মুসলেম উদ্দিন খান, মকবুল হোসেন, আমান উল্লাহ শফিক, আহমেদ শরফুল হোসেন, আমিনুর রহমান, পেয়ার আহমেদ আকাশ, আবদুল মাজেদ, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, রফিকুল ইসলাম (মুন্সীগঞ্জ), অশোক কুমার দাস, সাজ্জাদ হোসেন খান, রফিকুল ইসলাম (বগুড়া) ও শেখ হারুন। তাদের মধ্যে টোকাই সাগর যুক্তরাষ্ট্রে, সুব্রত বাইন, নবী, জয়, মোল্লা মাসুদ ভারতে, শাহাদাত ফ্রান্সে অবস্থান করছেন বলে খবর রয়েছে।
ইন্টারপোলের রেড নোটিশে আরো যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, এইচ বি এম নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান। তাদের মধ্যে মোসলেহ উদ্দিন জার্মানিতে, নূর চৌধুরী কানাডায়, রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, আবদুর রশিদ পাকিস্তানে, ডালিম লিবিয়ায় ও মাজেদ পাকিস্তানে রয়েছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তথ্য রয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার চার্জশিটভুক্ত অন্যতম আসামি মাওলানা মো. তাইজউদ্দিনের নামেও রয়েছে রেড নোটিশ। তিনি পাকিস্তানে আছেন বিভিন্ন সূত্রে এমন খবর মিললেও ইন্টারপোল সদর দফতরে কোনো তথ্য নেই। ভারতের তিহার জেলে আটক আছে জঙ্গি দুই ভাই মোরসালেহীন ও মুত্তাকীন।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে আছে ফরিদপুরের আবুল কালাম আজাদ, জাহিদ হোসেন, গোপালগঞ্জের আশরাফুজ্জামান খান, ফেনীর মুইন উদ্দিন চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সৈয়দ মো. হাসান আলী ও সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন এবং মঠবাড়িয়ার আবদুল জব্বারের নাম উঠেছে রেড নোটিশের তালিকায়। এছাড়া মডেল তিন্নি হত্যা মামলার আসামি সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভি, বিএনপি নেতা আবুল হারিস চৌধুরী ও কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের নামও রেড নোটিশে ঝুলছে। খবর রয়েছে গোলাম ফারুক অভি যুক্তরাষ্ট্রে, কায়কোবাদ দুবাই, হারিছ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর আবেদনে ২২ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ : বিদেশে অবস্থানকালীন হত্যা, মুদ্রা পাচার ও অন্যান্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ২২ জনের নামে রেড নোটিশ জারি হয়েছে। তারা হলেন ফজলুল আমিন জাভেদ (আবেদনকারী যুক্তরাষ্ট্র), জাহিদুল ইসলাম (যুক্তরাষ্ট্র), আলীম উদ্দিন খান (কানাডা), মো. জাকিউল জাকি (কানাডা), রউফ উদ্দিন (বেলজিয়াম), মো. পান্নু মিয়া (বাহরাইন), সুকুমার রাধা কান্ত বিশ্বাস (ওমান), শফিকুল (ভারত), মো. মনির ভূইয়া (ভারত), শেখ মো. ফারুক (ভারত), মো. সবুজ ফকির (ভারত), সামির আঞ্জুমান (ভারত), মোহাম্মদ আলী (ভারত), মো. সামিরউদ্দিন (ভারত), কামরুল আলম মুন্না (ভারত), কামরুজ্জামান (ভারত), মোহাম্মদ রানা (ভারত), আবদুল আলীম শরিফ (ভারত) মোহাম্মদ আলাউদ্দিন (মালয়েশিয়া), খোরশেদ আলম (বেলজিয়াম), মঞ্জুরুল ইসলাম চৌধুরী (মেক্সিকো) ও হানিফ (মাল্লীপ)।