পিন্টু দেবনাথ, কমলগঞ্জ থেকে :
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ঐতিহাসিক মাধবপুর জোড়ামন্ডপে ও আদমপুর রাস মন্ডপে মণিপুরীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শুক্রবার ৩ নভেম্বর মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে। এ মহারাসলীলায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায় ও মৈথৈ সম্প্রদায়ের মণিপুরী মেয়েরা গোপী সেজে শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাসলীলায় মেতে উঠবে। এ লীলার অনেক তাৎপর্য রয়েছে। মণিপুরী মেয়েরা গোপী সেজে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের আস্বাদন উপলব্ধি করবে এবং গভীর রাতে মহামিলনে আবদ্ধ হয়ে হারিয়ে যাবে।
মণিপুরীদের মহারাস বলতে প্রেমরসকে বুঝানো হয়। বস্তুত রস শব্দ থেকেই রাস শব্দটির উৎপত্তি। রস আস্বাদনের জন্য রাধাকৃষ্ণের লীলানুকরণে নৃত্য গীতের মাধ্যমে যে উৎসব উদযাপন করা হয় তাই রাসোৎসব। নৃত্য, সংগীতে মণিপুরীদের প্রাচীন জাতীয় লোক নৃত্য ‘লাই হারাওবা” থেকেই রাস নৃত্যের সৃষ্টি।
জানা যায়, ১৭৭৯ খৃস্টাব্দে মণিপুরের মহারাজ স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যে নৃত্য গীতের প্রবর্তন করেছিলেন তা-ই রাস নৃত্য। মহারাজার মৃত্যুর একশত বছর পরে মহারাজ চন্দ্র কীর্তির শাসনামলে গোটা রাস নৃত্য আচৌকা ভঙ্গী, বৃন্দাবন ভঙ্গী, খুডুম্বা ভঙ্গী, গোষ্ট ভঙ্গী, গোষ্ট বৃন্দাবন ভঙ্গী, আচৌবা, বৃন্দাবন ভঙ্গী তাণ্ডব পর্যায়ে পড়ে।
উলে¬¬খ্য, মহারাজ ভাগ্য চন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশিরভাগই ছিলেন নৃত্য গীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাস নৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন। এর ফলে মণিপুরীরা এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই ১৯৪২ খৃস্টাব্দ থেকে আজও কোনও রূপ-বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে এ রাস উৎসব। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মনিপুরী নৃত্য শিক্ষা।
মনিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারীরা রাসলীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়। সোমবার রাতে শুরু হবে মহারাসলীলা। শুরুতেই শ্রীরাধা সাজে সজ্জিত একজন নৃত্যশিল্পী তার নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যের তালে তালে পরিবেশিত হবে মণিপুরী বন্দনা সঙ্গীত। শ্রীকৃষ্ণ রূপধারী বাঁশী হাতে মাথায় কারুকার্য খচিত ময়ুর পুচ্ছধারী এক কিশোর নৃত্য শিল্পী তার বাঁশির সুর শুনে ব্রজ গোপী পরিবেষ্টিত হয়ে শ্রী রাধা মঞ্চে আসবে। শুরু হবে সুবর্ণ কংকন পরিহিতা মনিপুরী কিশোরীদের নৃত্য প্রদর্শন। মণিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়ার ধুম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাবৎ বাড়িতে রাসধারী ও রাস লীলার উস্তাদ এনে শিক্ষা দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। মণিপুরী মেয়েদের রাস নৃত্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থান সহ ভারত থেকেও মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন সহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই ছুটে আসবেন। মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা শুধু কমলগঞ্জের নয় গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর (শিববাজার) জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা ১৭৫তম বার্ষিকী এবং আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গনে রাসোৎসব উদযাপন কমিটির উদ্যোগে মনিপুরী মৈ-তৈ সম্প্রদায়ের লোকজন ৩২ তম মহারাস উৎসব উদযাপন করবে। রাস উৎসব উপলক্ষে বসবে বিরাট মেলা। মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজন মেতে উঠবে আনন্দ উৎসবে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞাণী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে গোটা উৎসব অঙ্গন। মণিপুরী সম্প্রদায়ের পূণ্যস্থাণ হিসাবে বিবেচিত মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরী সাদাকাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো এই একটি রাত্রির জন্য হয়ে উঠবে লাখো মানুষের মিলনতীর্থ। মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের।
জানা গেছে, কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী (বিষ্ণুপ্রিয়া) মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭৫ তম শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরন উৎসব। নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচী । আদমপুরের শ্রীশ্রী সানাঠাকুর ম-পে রাখাল নৃত্য, গুণীজন সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে।
৩ নভেম্বর দুপুর ১টায় বেনিরাস, সন্ধ্যা ৬টায় কৃর্তি মনিপুরী সন্তান সম্মাননা অনুষ্টান ও ৪ নভেম্বর শেষ দিন সকাল সাড়ে ১১টায় গোষ্টলীলা(রাখালনৃত্য), সন্ধ্যা ৭টায় ১৭৫তম শ্রী শ্রীকৃঞ্চের মহারাসলীলা স্মারক শুভ উদ্বোধন, রাত সাড়ে ৭ টায় আলোচনাসভা ও রাত সাড়ে ১১টায় মহারাস নৃত্য অনুষ্টান। মনিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারন সম্পাদক শ্যাম সিংহ বলেন, এবারো অনুষ্ঠান মালা আমরা তিনদিন ব্যাপী করেছি। অনুষ্টানে এবারো হাজারো দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের আগমন ঘটবে। অনুষ্ঠানে নিরাপত্তায় পুলিশের তিন স্তরের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে।