২৯ বছরে সিলেটে ছাত্র রাজনীতিতে অর্ধশতাধিক হত্যাকান্ড

333

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ছাত্র রাজনীতির ঘৃণ্য থাবায় এ যাবত পর্যন্ত প্রাণহানি ঘটেছে প্রায় অর্ধশতাধিক। ৮৮’ সালে ভয়ংকার শিবির চক্রের হাতে ঘৃণ্য খুনে শুরু হওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বারবার। মতাদর্শগত ফারাক, নিয়ন্ত্রণহীন রাজনৈতিক অবস্থা, গ্র“পিং, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, লেজুর বৃত্তিত্বে সৃষ্ট একাধিক উপ-গ্র“প এর খেসারত হিসেবে অকালেই প্রাণ যাচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের। সিলেটে একের পর এক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রকাশ্য রাজপথে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলেও রাষ্ট্রযন্ত্র থাকে নির্বিকার। গত দুই যুগে সিলেটের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘাতকের নির্মম বলি হয়েছেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক অপ ছাত্র রাজনীতির করাল গ্রাসে এ অবস্থায় অভিভাবকবৃন্দকে নিয়তই থাকতে হয় অজানা আশংকায়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বাড়ছে তাই অভিভাবক মহলেও আশংকা। বিশেষ করে চলতি বছরে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্র“পের হাতে দলীয় কর্মী নিহত হবার ঘটনায় নতুন করে আশংকা দেখা দিয়েছে। একইভাবে দলের ৩ কর্মী মৃত্যুর ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে অভিভাবক মহলেও বিরাজ করছে চরম উৎকণ্ঠা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে খুন, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, বিরাজ করছে।
নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্ন ফাঁস, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে কোন্দল আর আধিপত্যে শিক্ষাঙ্গনে বাড়ছে সহিংসতা । সিলেটের শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এমসি কলেজ, মদনমোহন কলেজ, সরকারি কলেজ, ভেটেরিনারি কলেজ, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজসহ এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ঘাতকের অস্ত্র কোনো মেধাবীর প্রাণ কেড়ে নেয়নি। আর এ কারণে অভিভাবকরাও সন্তানদের ক্যাম্পাসে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন না। সর্বশেষ গত ১৬ অক্টোবর প্রকাশ্যে লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র ওমর আহমদ মিয়াদ টিলাগড়ে দলীয় প্রতিপক্ষ গ্র“পের হাতে প্রাণ হারায়। অবশ্য, খুনের ধারাবহিক সবগুলো ঘটনাই ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের মাধ্যমেই বারবার সংঘটিত হয়েছে।
১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। সেদিন শিবির ক্যাডাররা জাসদ ছাত্রলীগের তিন নেতা মুনীর-ই-কিবরিয়া চৌধুরী, তপন জ্যোতি ও এনামুল হক জুয়েল খুন করে। শিবির চক্রের গা শিহরিত ভয়ানক এই ট্রিপল মার্ডারের কাহিনী আজো ভুলেনি সিলেটের মানুষ। পরের ঘটনা শুরু হয় ৯১’ সালে। সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে ছাত্রদল কর্মীকে হত্যার মাধ্যমে শুরু হয় ছাত্রলীগের ঘৃণ্য খুনের অধ্যায়। এরপর থেকে সেই সহিংস রাজনীতি বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ বছরে সিলেটে ছাত্র সংগঠনগুলোর কোন্দল, হামলা, সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে ৪৬ জন। এর মধ্যে ছাত্রলীগের হাতে নিহত হয়েছে ১০, শিবিরের হাতে ৭ এবং ছাত্রদলের হাতে ২ জন। ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৪ এবং ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৫ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া ছাত্র রাজনীতিকেন্দ্রিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছে আরও ৮ জন। এসব ঘটনায় যথারীতি থানায় মামলা হয়েছে। কিন্তু একটি মামলায়ও হত্যাকারীরা শাস্তি পায়নি।
৯২’ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের গুলিতে প্রাণ হারান এক পুলিশ সদস্য। একই বছর সিলেটের বিশ্বনাথ কলেজে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান দলীয় কর্মী বিধান। ৯৩’ সালের ২৩ মে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রাবাসের গেটে নিহত হন ছাত্রদল নেতা দুলাল। ৯৪’ সালে মদনমোহন কলেজে ছাত্রলীগের কোন্দলে খুন হন এক কর্মী। একই বছর ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন এনামুল হক মুন্না। ৯৫’ সালে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হত্যা করা হয় মুরাদ চৌধুরী সিপারকে। একই বছরের ২১ নভেম্বর সিলেট এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণ হারান ছাত্রদল নেতা মুহিন খান। এর ঠিক এক মাস পর শাহজালাল সেতুর ওপর খুন করা হয় শিবির নেতা আবদুল করিমকে। ৯৬’ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি নির্বাচন চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রলীগ নেতা নাহিদ। একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের হাতে খুন হন এমসি কলেজ ছাত্রদল নেতা বাবুল আহমদ রাহি। ৯৭’ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যান ছাত্রদল কর্মী রুহুল আমিন। ৯৮’ সালের ২৩ মে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের ব্রাশফায়ারে নিহত হন শিবির নেতা মহসীন। পরদিন ২৪ মে এ ঘটনার জের ধরে ব্লুবার্ড স্কুলের সামনে ছাত্রলীগ নেতা সৌমিত্র বিশ্বাসকে একা পেয়ে খুন করে ছাত্রশিবির। ৯৯’ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্রদলের হাতে নিহত হন স্বপন নামে এক ছাত্রলীগ নেতা। আগস্ট মাসে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন ছাত্রদল কর্মী বকুল ধর। সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় নিহত হন ছাত্রদল নেতা জগলু। নভেম্বর মাসে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন ছাত্রলীগ নেতা জুয়েল। একই মাসে নিজ সংগঠনের কর্মীদের হাতে খুন হন ছাত্রদল কর্মী ঝুটন মজুমদার। ২৫ ডিসেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গুলিতে খুন হন মাদ্রাসাছাত্র ও শিবির কর্মী বেলাল। ২৮ ডিসেম্বর টিলাগড় পয়েন্টে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের বন্দুকযুদ্ধের সময় ক্রসফায়ারে নিহত হন আতাউর রহমান নামের এক পথচারী যুবক। ২০০১ সালের ৩ মে আবদুল হালিম ও ১০ অক্টোবর ফখরুল ইসলাম খুন হন। তারা উভয়ই ছাত্রদল কর্মী এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তারা নিহত হন। ২০০২ সালের ২৭ জানুয়ারি মদনমোহন কলেজ ছাত্রদল নেতা মোমিনকে ছাত্রলীগ কর্মীরা পাঠানটুলায় তার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। একই বছরের ২৮ জুলাই জাহাঙ্গীর শামীম নামের ছাত্রদল নেতা ওসমানী মেডিকেলের গেটে এবং ৯ সেপ্টেম্বর মদনমোহন কলেজ ক্যাম্পাসে শিবিরের হাতে নিহত হন ছাত্রদল নেতা হামিদ আহমদ খান। একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শিবিরের হাতে খুন হন মদনমোহন কলেজ ছাত্রদল নেতা হামিদ খান দুয়েল, ২০০৩ সালে কলবাখানি এলাকায় ছাত্রদলের দুই গ্রুপে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন সাহাদ আহমদ। ২০০৪ সালের ৩১ আগস্ট শিবিরের হাতে নিহত হন সরকারি ভেটেরিনারি কলেজের ছাত্র রফিকুল হক সোহাগ। একই বছরের ১৭ অক্টোবর ছাত্রদল কর্মীরা মেস থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে খুন করে সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মিজান কামালীকে। ২০০৫ সালের ১৪ জুলাই ছাত্রদলের কোন্দলে হত্যা করা হয় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটনকে। ২০০৬ সালের ১৪ মে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ও জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে মোশারফ হোসেন মারা যান। ১৭ এপ্রিল এইডেড স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী রেজওয়ানের শ্বাসনালী কেটে নেয় তার সহপাঠীরা। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। ২০১০ সালের ১২ জুলাই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর ছাত্রদল কর্মীদের হাতে খুন হন মদনমোহন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আল মামুন শিহাব। ২০১২ সালে নিজ দলের ক্যডারদের হাতে শিবগঞ্জে খুন হন ছাত্রদল নেতা মেহরাব সিদ্দিকি সজিব। একই বছরের ২২ মার্চ ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে খুন হন ছাত্রদল নেতা মাহমুদ হোসেন শওকত। ২০১৩ সালে ছাত্রশিবির ক্যাডারদের হাতে খুন হন ছাত্রলীগ নেতা জগৎজ্যোতি। চলতি বছরের ৪ জুন চাঁদা না দেয়ায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস শেষ বর্ষের ছাত্র তাওহিদকে ছাত্রলীগের টর্চার সেলে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে খুন করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। একই বছর প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হন মদনমোহন কলেজের ছাত্র সোহান। ১৪ জুলাই রাতে ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ কচিকে খুন করে নিজ দলের ক্যাডারা। ২৭ জুলাই নগরীর পাঠানটুলায় গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও মহানগর ছাত্রদল নেতা জিল্লুল হক জিলু আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজ দলের কর্মীদের হামলায় নিহত হন। ২০১০ সালের ১২ জুলাই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে নগরীর টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। একই বছরের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের পার্থ-সবুজ গ্র“পের সাথে অঞ্জন-উত্তম গ্র“পের বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী সুমন চন্দ্র দাস। ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় সিলেট মদনমোহন কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয় আব্দুল আলী (১৯)। ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগের গ্র“পিংয়ের শিকার হয়ে মুত্যু হয় হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী কাজী হাবিবুর রহমানের।
চলতি বছরের ১৭ জুলাই সোমবার দুপুরে সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের ১০২নং শ্রেণি কক্ষের ভিতরে নিজেদের অবস্থানে পাইপগানের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক পাভেল গ্র“পের কর্মী খালেদ আহমদ লিটু। ঐদিন বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবুল কাশেম পল্লব ও জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক পাভেল মাহমুদ গ্র“পের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন উপজেলা ছাত্রলীগকর্মী খালেদ আহমদ লিটু (২৩)।
এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ওই রাতেই নিহত লিটুর বাবা ফয়জুর রহমান বাদী হয়ে পাভেল গ্র“পের ছাত্রলীগকর্মী ফাহাদ আহমদসহ মোট সাতজনকে আসামি বিয়ানীবাজার থানায় মামলা করেন।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে নিজ দলের কর্মীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। এ ঘটনায় মাসুমের মা আছিয়া বেগম বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন।