বিছনাকান্দি ঘুরে দেখা

121

নিরেশ চন্দ দাস

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির -বিন্দু।।
ভ্রমণপিপাসু মানুষ দের কাছে ভ্রমণের চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছুই নেই। ভ্রমণটি হতে পারে দেশে, হতে পারে বিদেশে, কাছে কিংবা দূরে। নেশাখোর মানুষেরা নেশা না করলে যেমন পাগল হয়ে যায়, ভ্রমণখোর দের বেলায় ও তাই।
আমাদের প্রাতঃ ভ্রমণ ক্লাব (মর্নিং বার্ডস) এ ও তেমন কিছু নেশা খোর আছেন যারা দীর্ঘদিন বেড়াতে যাওয়ার সূযোগ না পেলে এমন উশৃংখল আচরণ করেন তাদের জন্য সকালের হাঠাই অসম্ভব হয়ে উঠে। তাঁরা আমাদের পরম বন্ধু। এদের অনেকেই বেড়াতে বেড়াতে ইতি মধ্যেই দেশে বিদেশে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
“পাগলামি ” শব্দটি এখন থেকে আমি আর ব্যবহার করবোনা। কারণ পাগলামির ফল যখন আমাদের নির্মল আনন্দের কারণ তখন তাকে আর পাগলামি বলা যায়না।
ডা: এন কে পাল, ডা: মোহাম্মদ শাহ এমরান, বিনয় সাহা, অজিত ভট্টাচার্য, ঘনশ্যাম সাহা,এবং আনোয়ার ভাই এর উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং নিখুঁত পরিকল্পনায় গত শুক্রবার ২৩ জুলাই সিলেট শহর থেকে মাত্র ২৫ কি: মি দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দি বেড়াতে যাই। পরিকল্পনা মাফিক সকাল ৮ টায় মর্নিং বার্ডস এর সদস্য রঞ্জিত কর্মকারের সৌজন্যে আলপাইন রেষ্টুরেন্টে সুস্বাদু প্রাত:রাশ সেরে আমরা ১৯ জন বিছনাকান্দি রওয়ানা হই। রাস্তায় বঙ্গবীর বাজারে এক দোকানে চা এবং সকালে রেষ্টুরেন্টে বেঁচে যাওয়া ঠাণ্ডা পরোটা (অনেকটা ফেটে যাওয়া ফুটবলের ভিতরে থাকা লাল ব্লাডারের রাবারের মতো। চিবানো যায় কিন্তু গলানো যায় না) দিয়ে দিনের ২য় প্রাতরাশ করি। সেখান থেকে পীরের বাজার, সাবেক গরুঘাট বাজারে যাই। পীরের বাজারে বিছনাকান্দিগামী অনেক নৌকা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমাদের নেতৃবৃন্দ ৩০ জন লোক অনায়াসে বসতে পারে এ রকম একটি নৌকা ১৮০০ টাকায় ভাড়া করেন। ভরা নদী দিয়ে গ্রাম বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা আর এক ঘন্টায় গন্তব্যে পৌঁছে যাব। ভোজন প্রিয় মানষেরা কি এতক্ষণ খালি মুখে থাকতে পারে? তাই ডা: এমরান দা খুন্তি নিয়ে বসে গেলেন আর এক ডা: এন কে পালের আনা অতিকায় পেয়ারা কাটতে। সাথে বিট লবন,কাসুন্দি ও মরিচের গুঁড়া। দেখলেই জিবে জল আসে। আস্বাদন করতে ২ হাদার পার বাজার হয়ে আমরা বিছনাকান্দি পৌঁছে যাই বেলা ১২.৩০ মি: নাগাদ। এ রকম ভরা বর্ষাতে আগে কখনো বিছনাকান্দি যাইনি। তাই কষ্ট হয়নি মোটেও। হাঁটতে ও হয়নি বরং নৌকা সরাসরি বাংলাদেশের প্রান্ত সীমায় পাথর কোয়ারিতে আমাদের নামিয়ে দেয়। তত ক্ষণে হাজার দুয়েক পর্যটক বিছনা কান্দির প্রাকৃতিক স্বচ্ছ সলিলে তাদের দেহ মনকে সমর্পণ করেছে পরম তৃপ্তিতে। এ যেন এক রকম প্রাকৃতিক বাসর শয্যা উন্মুক্ত আকাশের নীচে। এ আনন্দ শুধু তারাই অনুভব করবে যারা কখনো একবার এই স্রোত ধারায় নিজেকে সমর্পণ করেছেন অবলীলায়। একা নয় একসাথে পরিবারের আবাল বৃদ্ধ বনিতা।
বন্ধুগণ বিছনাকান্দি সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক। বাংলা দেশের সীমানা ঘেঁষে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। থরে থরে বিছানো উঁচু নীচু চোখ জোড়ানো সবুজ পাহাড়ের সারি । উপরে সাদা কালো ভাসমান মেঘের ভেলা। তার উপরে নীল আকাশ। এ দৃশ্য চোখে দেখে মন ভরানো যায় কিন্ত প্রকাশ করা যায়না। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ জমে জমে অবিরত বৃষ্টি হচ্ছে কিন্ত মেঘালয়ের পাহাড় তা ধরে রাখতে পারছেনা। শত শত ঝর্নার জল অসংখ্য গিরিপথ বেয়ে তীব্র গতিতে বালি, ছোট বড় অসংখ্য পাথর নিয়ে এসে বাংলা দেশের গোয়াইনঘাট উপজেলার মাটিতে স্রোতস্বিনীর স্বচ্ছ সলীলে বিরামহীন ভাবে বিছায়ে রাখছে অনন্তকাল থেকে তাই সম্প্রতি বিছনাকান্দি নামে পরিচিতি পেয়েছে সারা বাংলা দেশে । অন্তত দুই ঘণ্টা আমরা উক্ত পাথর বিছানো স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী তে অফুরন্ত আনন্দে অবগাহন করে, ডা: এমরানের সৌজন্যে আগে থেকেই বন্দোবস্তকৃত একটি ভাসমান রেস্তোরায় মাছ, মুরগীর মাংস, ভর্তা, সবজি ও ডাল দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ সারলাম। মূল্য জন প্রতি ২৫০ টাকা। সিলেটের মধুমিতা থেকে নেয়া দই দিয়ে পরিসমাপ্তি। এবার ঘরে ফেরার প্রস্তুতি। কিন্তু দোকানীরা ভারতীয় পণ্যের যে পসরা সাজিয়ে বসে আছে সেদিকে না তাকিয়ে কি ফিরতে পারা যায়? সবাই যার যার মতো কেনাকাটা করে ৩.৩০ মি আমাদের ঘরে ফেরা শুরু। নৌকায় বসেই আবার দা খন্তা। আম, আনারস, আপেল ও শসা। সৌজন্যে ডা:এন কে পাল, পরিবেশনে ডা: এমরান। আমাদের শুধু আনন্দ। দুর্ভাগ্য ঘনশ্যামের। তার নেয়া মুড়ি চানাচুর কেউ স্পর্শও করেনি।
একটি কথা উল্লেখ না করে পারছি না। এই সমস্ত ভ্রমণে যাবার সময় সবাই আনন্দে থাকে, কিন্ত আসার সময় দারুণ এক ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে, কিন্তু বিছনাকান্দির নির্মল আকাশ, স্নিগ্ধ বাতাস ও স্বচ্ছ স্রোতধারা কাউকে ক্লান্ত হতে দেয়না।।