ফরমালিনের বিষাক্ত ছোবলে দেশ

91

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

আধুনিক বিশ্বের উন্নতশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও যেমন দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পচ্ছে, তেমনি দিন দিন বেড়েই চলেছে নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ। বর্তমানে অন্যান্য সামাজিক অপরাধের মধ্যে পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল মেশানো একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের বাজারগুলো এখন ভেজাল পণ্যে সয়লাব। শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে পানীয়, শাক-সব্জি, ফল-মূল, মিষ্টি, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রসহ এমনকি ঔষধেও ভেজাল মেশানো হচ্ছে। এর ফলে আমাদের জাতীয় জীবনে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ অধিকাংশ জনসাধারণ এ বিষয়ে ভালোভাবে অবহিত নয়। জনসাধারণ জানেন না যে, তারা প্রতিনিয়ত খাদ্য বা পণ্যসামগ্রীতে কী ধরনের ভেজাল বা বিষক্রিয়ার সম্মুখিন হচ্ছেন। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল দিয়ে ভোক্তা ও ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করছে। ফলশ্র“তিতে স্বাস্থ্যহানিকর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরণের জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে দেশের জনসাধারণ। জনস্বাস্থ্য দিন দিন মারাত্মক হুমকির দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধি, বিকলাঙ্গ, অটিস্টিক ও মানসিক রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। অথচ বিশুদ্ধ, ভেজালমুক্ত পণ্য ও খাদ্যসামগ্রী প্রাপ্তি ভোক্তা সাধারণের আইনগত অধিকার। এমতাবস্থায় ভেজালমুক্ত, বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পণ্যসামগ্রী প্রাপ্তি বাংলাদেশের গণমানুষের অন্যতম প্রত্যাশা। মানুষ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আর এ মানুষের জন্যেই মহান আল্লাহ্ পৃথিবীকে অফুরন্ত নেয়ামত দ্বারা সাজিয়েছেন, যাতে তারা সুস্থ, সুন্দর শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে। অথচ আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে মানুষ তাঁর যথাযথ পরিচয় পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারছে না স্বীয় কুপ্রবৃত্তির অনুকরণের কারণে। কুপ্রবৃত্তির কারণেই মানুষ শিরক, যুজম, মিথ্যা, সুদ-ঘুষ, মদ্যপান, ধর্ষণ, অপহরণ, জবরদখল, খুন-খারাবী ইত্যাদির মত জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়। এসবের মতোই মানব সমাজের আরেকটি জঘন্যতম ঘৃণ্য অপরাধ হচ্ছে ভেজাল।
বাংলা একাডেমীর ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ পণ্য শব্দের অর্থ করা হয়েছে- বিক্রেতয় দ্রব্য; বেসাত; মূল্য; মাসুল; ভাড়া। সংকীর্ণ অর্থে পণ্য হলো কতগুলো আপাতক দৃশ্য (ঃধহমরনষব) গুণের সনাক্তকরণযোগ্য (রফবহঃরভরধনষব)  সমাবেশ। এ অর্থে প্রতিটি পণের সর্বজনবোধ্য একটি বর্ণত্মাক নাম আছে; যেমন, আপেল, স্টিল বা ক্রিকেট ব্যাট ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাপক অর্থে প্রতিটি পণ্যেও ভিন্ন ভিন্ন বাণিজ্যিক মার্কা (নৎধহফ) হলো ভিন্ন ভিন্ন একটি পণ্য। অুনরূপভাবে ট্যাবলেটের উপরে মার্কায় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও স্কুইব-এর এ্যাসপিরিন ও বায়ার-এর এ্যাসপিরিন হলো দুটো পৃথক পণ্য। কোম্পানি মার্কার এই ভিন্নতা ভোক্তার কাছেও পণ্যে পণ্যে পার্থক্য সূচিত করে এবং এতে পণ্য-সংজ্ঞাতেও ভোক্তার কাঙ্খিত তুষ্টি সাধিত হয়। ‘ভেজাল’ শব্দের অর্থ মিশ্রিত; মেকি; খাঁটি নয় এমন; উৎকৃষ্ট দ্রব্যের সঙ্গে নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণ; যে খারপ জিনিষ অন্য ভালো জিনিষের সঙ্গে মিশানো হয়; খারাপ জিনিষ মিশ্রণ; বিশুদ্ধ নয় এমন। ইংরেজীতে ভেজালের প্রতিশব্দ উল্লেখ করা হয়েছে-ঞড় পযবধঃ, ংরিহফষব; ঃড় ফড়ঁনষব পৎড়ংং; ঃড় ফবপবরাব, ভড়ড়ষ; ফবষঁফব; নষঁভভ, নবমঁরষব; ঃড় ঃৎরপশ, ফঁঢ়ব; এঁষষ. ভেজালের আবরী প্রতিশব্দ-‘আল-গাশশু’; ‘আল-খিদাউ’। প্রকৃতিগত পরিবর্তনের ফলে বস্তুর পরিচিতি যাই হোক না কেন, তাকে ভেজাল অথবা নকল যা-ই  আখ্যা দেয়া হোক না কেন, বিষয়টি ধর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু মানুষ কর্তৃক দ্রব্যটি আংশিক বা পরিপূর্ণ যেভাবেই পরিবর্তিত হোক না কেন মানবসমাজে তখন বস্তুটি ভেজাল বা নকল নামে অভিহিত হয়। অতি মুনাফার লোভে মানুষ যখন রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে চায়, তখন তাকে যে অনৈতিকতা, অসততার শরণাপন্ন হতে হয়, তাকে ‘ভেজাল’ নামে আখ্যয়িত করা হয়।  বাংলাদেশে পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল প্রতিরোধে প্রচুর আইন (খধংি), অ্যাক্টস (অপঃং), অধ্যাদেশ (ঙৎফরহধহপবং), মাহামান্যরাষ্ট্রপতির আদেশ (চৎবংরফবহঃ ঙৎফবৎ), বিধি-বিধান (জঁষবং) বিদ্যমান আছে। প্রয়োজন শুধু এসব বিদ্যমান আইন-কানুনসমূহের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। প্রচলিত আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতিসমূহ সততা, আন্তরিকতা, নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রয়োগ করা হলে বাংলাদেশে পণ্যে ভেজালের সার্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে বাধ্য। আমাদের অনেক আইন আছে, যেগুলোর প্রয়োগ নেই। আবার অনেক আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। তাই বলা যায়, পণ্যে ভেজাল ও নকল প্রতিরোধে আমাদের পর্যপ্ত পরিমাণে আইন-কানুন বিদ্যমান। প্রয়োজন শুধু এসব সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী করা। বাংলাদেশে পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে বিদ্যমান আইন-কানুনসমূহের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরা হলো:
বাংলাদেশে পণ্যসামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য ও ঔষধে ভেজাল প্রতিরোধে সবচেয়ে পুরাতন আইন ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি। দন্ডবিধি ২৭২, ২৭৩, ২৭৪, ২৭৫, ২৭৬ ধারায় এ বিষয়ে শাস্তির বিধান যথাক্রমে ছয়মাস কারাদন্ড বা এক হাজার টাকার অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত করার বিধান আছে। তবে এসব আইনে যেমন মামলা হয়না; তেমনি আইন প্রয়োগও হয় না। বাংলাদেশে ২০০৫ সাল থেকে উপরিউক্ত দন্ডবিধিগুলোর ব্যাপক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন শুরু হয়। উক্ত ধারাগুলোতে শাস্তি কম হলেও কারাদন্ড ও অর্থদন্ড উভয় ধারা মিলে ১ (এক) বছর কারাদন্ড দেয়া হলে ভেজালকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চার হয়। পণ্যসামগ্রী ও খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল প্রতিরোধে আমাদের দ্বিতীয় আইন ১৮৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ যা ২০০৫ সালে সংশোধন করা হয়। এই অধ্যাদেশ ভেজালকারীদের শাস্তি তিন লক্ষ টাকা, ১ (এক) বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং দোকান বা কারখানার যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করার বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশে পণ্যসামগ্রী, খাদ্যসামগ্রী, ঔষধ এবং প্রসাধনসামগ্রীতে ভেজাল প্রতিরোধে সবচেয়ে শক্তিশালী আইন হচ্ছে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। এই আইনে ভেজাল কারবারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যৃদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১৪ (চৌদ্দ) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারদন্ড এবং জরিমানার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ১৯৮৫ সালে বি.এস.টি.আই অধ্যাদেশ জারি করা হয়, যা ২০০৩ সালে সংশোধন করা হয়। এতে ভেজাল কারবারীদের সর্বোচ্চ এক্ষ টাকা জরিমানা এবং মামলার বাজেয়াপ্ত ও কারখানা বন্ধ করে দেয়ার বিধান করা হয়। ‘ উল্লেখিত আইনগুলো ছাড়াও বাংলাদেশে পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল প্রতিরোধ ২০০৫ সাল থেকে ভেজালবিরোধী মোবাইল কোর্ট চালু করা হয়। অপরাধের ধরণভেদে এ কোর্ট তাৎক্ষণিক জরিমানা ও শাস্তি দিয়ে থাকে। দেশে পণ্যে ভেজাল মিশ্রণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, অতি মুনাফা অর্জন করার মানসিকতা। এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষই তার অবস্থাগত দিক থেকে মনে করে, যেভাবেই হোক না কেন যত দ্রুত অর্থ উপার্জন করা যাবে, ততই ধনী হওয়া যাবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। এ দেশের রাজনীতিতে পরিচ্ছন্নতা ও জবাবদিহিতা লক্ষ্যণীয় ভাবে কম। এর বিরূপ প্রভাব জনজীবনের সর্বস্তরেই পড়েছে। ফলে খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যে যে বিষ ঢালাওভাবে মেশানো হচ্ছে এবং তা বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ খুবই ক্ষীণ। পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি উচ্চ আসনে পৌঁছতে না পারার কারণে এর প্রভাব কেমিক্যাল আমদানিকারক সকল পণ্যের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং ভোক্তার মানসিকতার ওপর গিয়ে পড়েছে। সর্বগ্রাসী ভেজাল ও বিষক্রিয়ার এটি হলো প্রধানতম কারণ। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ শিক্ষিত ও স্বাস্থ্য সচেতন নয়। এ কারণে পণ্যে বা খাদ্যে ভেজাল সম্পর্কে তাদের সচেতনতা খুবই কম। এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যে ভেজাল দিয়ে সরলবিশ্বাসী ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করছে। বাংলাদেশের হাট-বাজার ও বিপণী-বিতানগুলোতে প্রতিনিয়ত ভেজাল পণ্য কেনা-বেচা হলেও যারা পণ্যে ভেজাল দেয় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয় না। ফলে পণ্যে ভেজালের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। তাই যথাযথ শাস্তি না হওয়াও বাংলাদেশে পণ্যে ভেজালের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। পণ্যে বা খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ একটি মারাত্মক সামাজিক অপরাধ। এ বিষয়ে বাংলাদেশে কঠোর আইন থাকলেও তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া পণ্যে ভেজালের অন্যতম কারণ। পণ্য এবং খাদ্যসামগ্রীতে যেসব কেমিক্যাল ও ভেজাল দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, তা বাংলাদেশে অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য। ফলে ভেজাল মিশ্রণকারীরা খুব সহজেই পণ্য এবং খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল মিশ্রণ করে থাকে। বাংলাদেশের হাট-বাজার ও বিপণী-বিতানগুলোতে বিজ্ঞাপন নির্ভর চাকচিক্যময় প্রচুর পণ্যসামগ্রী পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় সাধারণ ভোক্তাদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পছন্দ করতে হিমশিম খেতে হয়। স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে চটকদার বিজ্ঞাপন দারুণভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা কথার ফুলঝুরি আর স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বিজ্ঞাপন প্রচার করে প্রতিনিয়ত সাধারণ ভোক্তাগণকে প্রতারিত করছে। বাংলাদেশে এক সময় পণ্যে ভেজাল দেওয়া ছিল গুটিকয়েক ব্যবসায়ীদের মধ্যে সীমিত, আজ তা ঢুকে পড়েছে সমাজের সর্বত্র। ভেজাল পণ্য বাজারের সর্বত্র বিরাজমান। মুনাফালোভী মানুষ রাতারাতি অর্থ-বিত্তশালী হওয়ার লক্ষ্যে ভেজালের কারবার করে যাচ্ছে। প্রতারিত হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। এখানে সাধারণ-অসাধারণে কোন কথা নেই, পার্থক্য নেই। এক কথায় পণ্যে ভেজাল ও বিষক্রিয়ার শিকার সবাই।
বাংলাদেশে ভেজাল পণ্য, খাদ্যদ্রব্য, পানীয় ও ঔষধের কারণে দেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। উদাহরণস্বরূপ যে মিষ্টি বিক্রেতা মিষ্টির মধ্যে সোডিয়াম সাইক্লামেট, স্যাগারিন, কাপড়ের ও চামড়ার ক্ষতিকর রং ব্যবহার করে বিক্রি করছেন, সেই মিষ্টি বিক্রেতা বাজার হতে ফরমালিন দেয়া মাছ অথবা দুধ খাচ্ছেন অথবা ফরমালিন দেয়া মাছ বিক্রেতা বাজার হতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রিত বিস্কুট খাচ্ছেন অথবা তার বাচ্চাকে ক্ষতিকর রঙিন চকলেট খাওয়াচ্ছেন। এভাবে বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ ভেজাল পণ্য এবং খাদ্যদ্রব্যের কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
টিভিচিত্র, সংবাদপত্রে এবং পণ্যের লেবেলে মনলোভা বিজ্ঞাপন দিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান দেশব্যাপী ‘ন্যাচারাল মিনারেল’ ও ‘পিউরিফইড ড্রিংকিং ওয়াটার’ নামে বোতলজাত পানি বারজাত করলেও এসব পনির শতকরা ৯৮ ভাগই বিশুদ্ধ, জীবাণুমুক্ত বা ন্যাচারাল মিনারেল সমৃদ্ধ নয়। অনুসন্ধনে জানা গেছে ইধহমষধফবংয ঝঃধহফধৎফং ধহফ ঞবংঃরহম ওহংঃরঃঁঃরড়হং (ইঝঞও)-এর বিধানমালা অনুযায়ী মিনারেল ওয়াটার ও পিউরিফইড ড্রিংকিং ওয়াটার প্রস্তুত করার জন্য বোতলজাত পানিতে স্বাস্থ্যসম্মত যেসব উপাদান থাকা বাধ্যতামূলক, অধিকাংশ পানিতেই সেসব উপাদানের উপস্থিতি নামমাত্র, আবার শরীরের জন্য ক্ষতিকারক যেসব জীবাণু বা পদার্থ শোধন করা অপরিহার্য, সেসব জীবাণুর প্রকট উপস্থিত রয়েছে এসব বোতলজাত পানিতে। ফলে মিনারেল ও বিশুদ্ধ পানির নামে বোতলজাত পানি কিনে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন এবং মোটা অংকের অর্থের অপচয় করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ পরিচালিত এক গবেষণায় দেশের পানি উৎপাদনকারী শিল্পের উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে ওঠে। দেশের প্রথম সারির পানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রিয় ব্রান্ডের পানিও এ তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। জানা যায়, পানির মান যাই হোক বাজারে পাওয়া নিম্নমানের প্রায় সবকটি পানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানই দেশের একমাত্র পণ্যদ্রব্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বি.এস.টি.আই-এর ছাড়পত্র পেয়েছে। বোতলজাত পানি উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াসার পানি ব্যবহার করে। তাদের নিজেস্ব ল্যাবরেটরি, ডিপটিউবওয়েল নেই।
বর্তমান বিশ্বেও অনুন্নত দেশগুলোতে ভেজাল একটি বড় রকমের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যার কবল থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও মুক্ত নয়। এ দেশে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। অসৎ ব্যবসায়ী সর্বদাই স্বল্প পুঁজিতে এবং স্বল্প সময়ে অত্যধিক মুনাফা অর্জন করতে চায়। এ কারণে তারা নীতি-নৈতিকতা মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে না। পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে পরিমাপে ও ওজনে কম দিয়ে, প্রতারণা করে, মজুদদারী করে, নিষিদ্ধ ও হারাম মিশিয়ে বিক্রি করে, অসাধু উপায়ে মানুষকে ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। মানুষের অধিকার, জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য সর্বোপরি মানুষের জীবন তাদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ বিষয়। অতচ আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জন ব্যবসায়ী মুসলিম। তারা সালাত আদায় করেন, রোযা রাখেন, হজ্জ করেন। অনেকে যাকাতও দেন। যাদের মধ্যে এমন ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ বিরাজমান, তার কিভাবে ব্যক্তি স্বার্থ চিরতার্থ করার জন্য বিভিন্ন কৌশলে পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল মেশান? নিম্নমানের পণ্যকে ‘এক নম্বর’ বলে চালিয়ে দিয়ে প্রতারণা করেন? খাদ্য-পণ্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল, বিস্ফোরক দ্রব্য, রং ও অরুচিকর উপাদান মেশান? বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। বাংলাদেশের হাট-বাজার, মার্কেট ও বিপণি বিতানগুলো ভেজাল পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা পরকালের মুক্তি ও সাফল্য লাভের চাইতে দুনিয়ার জীবনের সাফল্য ও ভোগ-বিলাসকে অত্যধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে তাদের ঈমানের ভিত্তি ও শক্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী। আর এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ইসলামী জ্ঞান চর্চা, গণসচেতনতা ও ইসলামের বিধি বিধানগুলোর প্রচারণা। সরকারি-বেসরকারি ও সমম্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এহেন প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি। উপর উল্লেখিত আলোচনা ও পর্যলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে নিম্নোক্ত সুপারিশমালা গ্রহণ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকারকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। জনস্বার্থ রক্ষার্থে সরকারকে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের সদিচ্ছাটাই দেশের জনগণের দুর্দশা ঘোচানোর জন্য বড় প্রভাব ফেলতে পারে। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন অত্যন্ত জরুরী। বি.এস.টি.আই-এর কার্যক্রম শক্তিশালী করা ও সারা বছর বাজারে তাদের কার্যকর নজরদারি অব্যহত রাখা। এ ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য সরকার দু’ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমত, খাদ্য ও পণ্য ভেজাল ও বিষাক্রিয়ার চরম ভয়াবহতার দিকগুলো জনসাধারণকে অবহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভেজাল ও বিষমিশ্রণের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার মতো যথেষ্ট আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে। ভেজাল ও বিষমিশ্রণকে আইনের দৃষ্টিতে চরম অপরাধমূলক কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে ভোক্তা অধিকার আইন এবং সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতকরণ যতদিন না আমাদের দেশে হবে, ততদিন পণ্যে ভেজাল চলতেই থাকবে। এ ছাড়া পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে সারা বছর এ অভিযান অব্যহত রাখতে হবে। বাংলাদেশে পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল প্রতিরোধের লক্ষ্যে আগ্রাসী, অতি দ্রুত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসায়িক ধারার এবং ব্যবসায়িক-রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হওয়া অতি জরুরী। ব্যবসায়ীদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা মনে রেখে সৎভাবে মুনাফা অর্জনের সদিচ্ছা করতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যম জনস্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে। পণ্য ও খাদ্যে ভেজালের ঘটনাগুলোকে গণমাধ্যম কর্মীরা বিভিন্ন মিডিয়াতে পরিবেশন করতে পারেন। পাশাপাশি মিডিয়াগুলোকে ‘ফলো-আপ রিপোর্ট’ করতে হবে। অর্থাৎ পণ্যে বা খাদ্যে ভেজাল ও বিষমিশ্রণসহ যে কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর থেকে শুরু করে তার শেষ পরিণতি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে লেগে থেকে লাগাতার সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। যেটি আমাদের মিডিয়া জগতের একটি বড় দুর্বলতা। সংঘটিত এ ধরনের অপরাধের ধারাবাহিক সংবাদ যদি পরিবেশন করা যেত, তাহলে দর্শক বা শ্রোতা সরকারের প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সবাই পুরো ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারতো। এতে একদিকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেতো, অন্যদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমূহের দায়িত্বশীল লোকজনের মধ্যে তৎপর থাকার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হতো। এর ফলে নিশ্চিয়ই একটি দীর্ঘমেয়াদী সুফল আমরা পেতাম। বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি সচেতন। এদেশে অসংখ্য রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে, যারা তৃণমূল পযৃন্ত সর্বস্তরের জনসাধারণের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। তাই রাজনৈতিক সংগঠনগুলো পণ্যে ভেজালের নানাবিধ ক্ষতিকর দিক জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে পারেন। ভেজাল মিশ্রণ বন্ধে জনগণকে সচেতন করে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে পারেন। সর্বোপরি রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে দেশ শাসন করে। তাই পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরী এবং ফলপ্রসূ হবে বলে আমরা মনে করি। আমরাই প্রতিনিধিত্ব করছি সমাজের, এই দেশের। আমাদের দেশে অসংখ্য সামাজিক সংগঠন রয়েছে যারা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণে কাজ করে। আমাদের চিন্তা-চেতনা, মননশীলতা দিয়ে সমাজকে ভেজাল ও দুষণমুক্ত করা আমাদেরই দায়িত্ব। তাই সামাজিকভাবে একজন ভেজাল মিশ্রণকারী চোর-ডাকাতের মতো হেয় করলে, তার সঙ্গে পরিবারিক সম্পর্ক স্থাপন না করলে, তাকে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক এবং পারিবারিক অনুষ্ঠানে না ডাকলে পরিবর্তন হতে বাধ্য।
জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে। আমাদের ও আমাদের সন্তানদের শরীর-স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য পণ্যে ভেজালকারবারীদের বিরুদ্ধে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলি, তা অবশ্যই সফল হবে। তাই বাংলাদেশের পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধ ব্যক্তিগত পর্যায় হতে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তরে সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে জনসাধারণের করণীয় হলো- ১. খাদ্য এবং পণ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া; ২. পণ্যে ভেজাল রোধে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষকে সচেতন করা; ৩. ভোক্তা অধিকার বা ক্রেতার অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া; ৪. সিটি কর্পোরেশন, মিউনিসিপালিটি, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে সক্রিয় ও নিয়মিতভাবে দায়িত্ব পালন করা; ৫. সাময়িকভাবে নয়; বরং সারা বছর ভেজালবিরোধী অভিযান সৎ ও দক্ষ লোকের (ম্যাজিস্ট্রেট) মাধ্যমে পরিচালনা করা; ৬. বি.এস.টি.আই-এর যথাযথ দয়িত্ব পালন এবং সর্বদা বাজার তদারকি করা; ৭. সকল ব্যবসায়ীকে সৎভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা। ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু অর্থোপার্জনের একটি মাধ্যম নয়, এটি মানবসেবার অন্যতম একটি মাধ্যম। এ কারণে ব্যবাসা- বাণিজ্য সম্পর্কিত বহুবিধ তথ্য পবিত্র কুরআন ও হাদীসে উপস্থাপিত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত পদ্ধতিগুলোর শরীআসম্মত নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, ইসলাম কীভাবে ক্রেতা বিক্রেতা এবং ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সর্বাধিক কল্যাণ নিশ্চিত করেছে।
সুতরাং আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে পণ্যসামগ্রীতে যেভাবে ভেজাল মিশিয়ে কেনা-বেচা করা হচ্ছে তা জনসাধারণের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরণের ব্যবসায় ইসলামে সর্বাবস্থায় হারাম। একজন মুমিন-মসলিম ব্যবসায়ী এহেন হারাম ব্যবসা পরিত্যাগ করে হালাল ব্যবসা পরিচালনা করবেন, এটাই আমরা আশা করি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যদি সৎভাবে ব্যবসা পরিচালনা করেন, ক্রেতাসাধারণ যদি সঠিক পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বন করেন, সর্বোপরি সরকারি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যদি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেন, তাহলে বাংলাদেশে পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।