স্টাফ রিপোর্টার :
স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে রামদা দিয়ে ঘুমন্ত অবন্থায় প্রথমে তার দেহ দু’খন্ড করে মাথাটি বাড়ির পাশে একটি টিলার গর্তে পুতে রেখে মাথাবিহীন দেহ ফেলে আসি জঙ্গলে। স্বামী খুনের লোমহর্ষক এমন হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিলেন নিহতের ৩য় স্ত্রী পারভীন আক্তার। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (আমলী-৩) মোঃ মামুনুর রহমান সিদ্দিকীর আদালতে পারভীন এ হত্যার দায় স্বীকার করে এভাবে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। আদালতের বিচারক মোঃ মামুনুর রহমান সিদ্দিকী তার খাসকামরায় প্রায় দেড় ঘন্টায় পারভীন আক্তারের এ জবানবন্দী রেকর্ড করেন।
পারভীনের বরাত দিয়ে শাহপরান থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) নিজাম উদ্দিন চৌধুরী জানান, গতকাল আটক পারভীন আক্তার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওসি জানান,আলী হোসেন স্ত্রী পারভীনকে ভরণ-পোষণ দিতেন না। সে একাধিক বিয়ে করায় অন্য স্ত্রীর কাছে চলে যেত। মাঝে মধ্যে পারভীনের কাছে আসত এবং নির্যাতন করত। এ ক্ষোভে পারভীন পরিকল্পনা করে আলী হোসেনকে নিমর্মভাবে খুন করে লাশ গুম করে। তিনি বলেন, গতকাল ময়না তদন্ত শেষে নিহতের লাশ তার আত্মীয় স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে এ ঘটনার সাথে আর কেউ জড়িত রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার বিকেলে নিহতের স্বজনরা জাফলং থেকে এসে শাহপরান থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার বিকেলে পারভীন বেগমকে আটক করে শাহপরান (রহ.) থানা পুলিশ। আটকের পর পুলিশের কাছে স্বামী হত্যার বর্ণনা দেন পারভীন। এমন হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটেছে শাহপরান থানার পীরেরবাজার শাহসুন্দর মাজার সংলগ্ন মোকামেরগুল এলাকায়। সোমবার সন্ধ্যায় বাড়ির পার্শ্ববর্তী টিলা থেকে খন্ডিত মাথা ও জঙ্গলে ফেলা মাথাবিহীন দেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় মরদেহের শরীর থেকে মাংস ঝরে পড়ছিল। পারভীনের স্বামীর নাম আলী হোসেন (২৫)। চার সন্তানের জনক আলী হোসেন শহরতলীর মোকামেরগুলের কবির মিয়ার বাড়ীতে স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং ইউনিয়নের রহমতপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মৃত শফিকুর রহমানের পুত্র। নিহত আলী হোসেন প্রথমে ট্রাক চালক ছিলেন। পরে পাথর ব্যবসা করতেন। এক ঘটনায় নিহত আলী গতকাল মঙ্গলবার নিহতের ভাই জমির হোসেন বাদি হয়ে একমাত্র পারভীন আক্তারের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামী করে শাহপরান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। নং- ১২।
পুলিশ জানায়, সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও দাসপাড়ার দাশপাড়া এলাকার সুরুজ আলীর মেয়ে পারভীন আক্তার তিন বছর আগে পাথর ব্যবসায়ী আলী হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি আলীর ৩য় স্ত্রী। আলীর অন্য দুই স্ত্রী জাফলংয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে অবশ্য তার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে পারভীন বেগম দাবি করেন, তার স্বামী আলী হোসেন তিন বিয়ে করেছেন। স্বামী প্রায় সময় তাকে নির্যাতন করতেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাসখানেক ধরে স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। প্রতিদিন রাম দা শান দিয়ে রাখেন। কিন্তু হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তবে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন গত ৪ নভেম্বর ভোররাতে। ঘুমন্ত অবস্থায় দুই কোপে স্বামীর মাথা বিচ্ছিন্ন করেন পারভীন। বিচ্ছিন্ন মাথাটি পার্শ্ববর্তী একটি টিলার গর্তে পুতে রাখেন। আর মরদেহ প্রথমে ঘরের মেঝেতে গর্তে পুতে রাখেন। এরপর ৫ নভেম্বর রাতে মরদেহ রশি দিয়ে টেনে নিয়ে জঙ্গলে ফেলে রাখেন। পারভীন জানান, হত্যাকান্ডের রাতে তার বাবা (আলীর শ্বশুর) সুরুজ আলী বাসায় অবস্থান করলেও তাকে বেশ ক’টি ঘুমের বড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন তিনি। এ ঘটনায় সুরুজ আলীকে আটক করলেও গত সোমবার রাতে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। হত্যাকান্ডের ছয় দিনের মাথায় গত সোমবার মোকামেরগুল বাড়ির পাশের জঙ্গল থেকে আলী হোসেনের মাথাবিহীন দেহ উদ্ধার করা হয়। পারভীনকে আটককালে ঘর থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত রক্তমাখা একটি রাম দা উদ্ধার করা হয়।
আলীর ছোট ভাই জমির হোসেন বলেন, ৪ নভেম্বর থেকে ভাইয়ের খোঁজ পাইনি। অজ্ঞাত নাম্বার থেকে এক লোক মোবাইল ফোনে ভাইয়ের বন্ধু পরিচয় দিয়ে হত্যাকান্ডের কথা জানায়। যে কারণে থানায় এসে সাধারণ ডায়েরি (নং-৪২৭) করি আমরা। তিনি বলেন, ৩ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে আলী হোসেন মেঝো। তার প্রথম স্ত্রীর ঔরসজাত তিন সন্তান এবং তৃতীয় স্ত্রীর এক সন্তান রয়েছে। তবে মেঝো স্ত্রীর সঙ্গে বাল্যকালে বিয়ে হলেও পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
আলীর ভগ্নিপতি তোতা মিয়া ও বন্ধু হেলাল আহমদ বলেন, পারভীন একাই তার স্বামীকে হত্যা করেছেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে আরও লোকজন জড়িত থাকতে পারে। বিষয়টি পুলিশকে খতিয়ে দেখতে হবে। এদিকে, সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির পর রাত ১০টার দিকে শাহপরান থানার এসআই ফজলে মাসুদ উদ্ধারকৃত খন্ডিত মরদেহ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে পাঠান।