ছাতক থেকে সংবাদদাতা :
ছাতকের চাঞ্চল্যকর ইমন অপহরণের ২২দিন পর হাওর থেকে ইমনের মাথার খুলি, চোয়াল ও হাতের হাড় উদ্ধার করেছে পুলিশ। রিমান্ডে আনা আসামীদের দেয়া তথ্য ভিত্তিতে গতকাল শনিবার দুপুরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বাতিরকান্দি গ্রামের হাওরের বিভিন্ন স্থান থেকে তার মাথার খুলি, চোয়াল ও হাতের হাড় উদ্ধার করে। ইমনের লাশ উদ্ধারের খবরে বাতিরকান্দিসহ আশপাশের গ্রামের শ’শ উৎসুক জনতা হাওরে এসে ভিড় জমায়। এ সময় ইমনের পিতা প্রবাসী জহুর আলী ঘটনাস্থলে পৌঁছে মাথার খুলি ও দাঁত দেখে শনাক্ত করে ইমনের বলে পুলিশকে জানান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আফজাল আবেদীন আবুল ইমন হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সকল খুনিকে গ্রেফতার ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে খুনিদের ফাঁসি দাবী করেন। ইমনের মাথার খুলি, চোয়াল ও হাতের হাড় উদ্ধার করা হলেও দেহের অন্যান্য অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে এ সময় ইমনের পরিবারে আবারো আহাজারিতে বাতিরকান্দি এলাকায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
যেভাবে অপহরণ হলো ইমন : গত ২৭ মার্চ বিকেলে নোয়ারাই-দোয়ারা সড়কে বাতিরকান্দি গ্রামের নিজ বাড়ীর সামনে মোস্তাফিজুর রহমান ইমন খেলার ছলে সড়কে চলে আসে। আগে থেকে ওৎপেতে থাকা অপহরণকারীরা ইমনকে ফোরষ্ট্রোকে তোলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। অপহরণের প্রায় আধ ঘন্টার মাথায় মোবাইল ফোনে ২লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবী করে অপহরণকারীরা। ইমনকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে অপহরণকারীরা মুক্তিপণের টাকা কয়েক দফা আদায় করে নেয়।
পুলিশের অভিযানে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হল যারা : অপহৃত ইমনের পিতা জহুর আলীর দায়ের করা জিডির ভিত্তিতে ছাতক থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২৯ মার্চ জড়িত সন্দেহে বাতিরকান্দি গ্রামের আব্দুল বাহার (৫৫) ও নুরুল আমিন (৪৫) ও ৬ এপ্রিল একই গ্রামের আব্দুল ওয়াজিদের পুত্র ফারুক মিয়া, আব্দুর রহমানের পুত্র রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালামের পুত্র জাহেদ আহমদকে গ্রেফতার করে। ৮ এপ্রিল অপহরণের মূল হোতা বাতিরকান্দি গ্রামের একটি মসজিদের ইমাম, জামায়াত নেতা সুয়েবুর রহমান সুজনকে সিলেট নগরীর কদমতলী বাসষ্ট্যান্ড থেকে গ্রেফতার করা হয়।
ইমন উদ্ধারে পুলিশের তল্লাশী অভিযান : তার স্বীকারোক্তি মতে ঘাতক সুজনকে সাথে নিয়ে পুলিশ অপহৃত ইমনের মৃতদেহ উদ্ধারে ৮এপ্রিল বুধবার দিনভর বাতিরকান্দি গ্রামের দু’টি খালসহ বিভিন্ন স্থানে তল্লাসী চালায়। খালের পানি নিষ্কাশন করে ব্যাপক তল্লাশী চালিয়ে ব্যর্থ হলেও মসজিদের সিঁড়ির পাশের একটি গর্ত থেকে রক্তমাখা লুঙ্গি, তোয়ালে, হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বিষের বোতল, একটি ছুরি ও সুজনের কাছ থেকে তার ব্যবহৃত বিভিন্ন কোম্পানীর ১৯টি সীম উদ্ধার করে পুলিশ। ইমনের মৃত দেহের কোন সন্ধান না পেয়ে সন্ধ্যায় তল্লাশী অভিযান শেষ করে পুলিশ।
ইমন অপহরণ ও হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা : তল্লাশী অভিযান চলাকালে ঘাতক সুজন শিশু ইমন অপহরণ ও হত্যা কান্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয় পুলিশের কাছে। তার বর্ণনা মতে ২৭ মার্চ বিকেলে নিজ বাড়ির পাশে ছাতক-দোয়ারা সড়ক থেকে শিশু ইমন অপহৃত করে ঘাতক সুজন ও তার সহযোগীরা। মুক্তিপণের দু’লক্ষ টাকা না পেয়ে অপহরণকারীরা বিভিন্ন স্থানে শিশু ইমনকে নিয়ে অবস্থান করতে থাকে। ৬এপ্রিল সোমবার রাতে ইমনের বাড়ী সংলগ্ন মসজিদের আঙ্গিনায় এনে ইমনকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেয় তারা। এ সময় শিশু ইমন পানির পিপাসায় ছটপট করতে থাকলে তাকে বিষ মেশানো পানি পান করতে দেয়া হয়। বিষ মিশ্রিত পানি পান করে যন্ত্রণায় ছটফট ও বমি করতে থাকলে ধরা পড়ার আশংকায় ঘাতক সুজনসহ তার সহযোগীরা ধারালো ছুরি দিয়ে ইমনকে জবাই করে হত্যা করে। ইমাম সুজন ইমনের মাথায়, জাহেদ তার হাতে ও পায়ে শক্ত করে ধরে রাখলে রফিক ধারালো ছুরি দিয়ে তাকে জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে ঘাতকরা ইমনের লাশ বস্তায় ভর্তি করে পার্শ¦বর্তী একটি খালে মাটি চাপা দিয়ে রাখে বলে জানায়। ছুরি, বিষের বোতল ও রক্তমাখা লুঙ্গি, তোয়ালে, মসজিদের আঙ্গিনায় একটি গর্তে পুতে রাখে তারা।
যে ভাবে ঘাতক সুজনকে গ্রেফতার করা হয় : অপহরণের পর থেকে ঘাতক মসজিদের ইমাম ঘাতক সুজন এলাকায় থেকে ইমনের পরিবারের সাথে সখ্যতা বাড়িয়ে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে সুজনের রহস্যজনক আচরণে ইমনের পরিবার তাকে সন্দেহ চোখে দেখলে সে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যায়। তখন থেকে ঘাতক সুজন ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার করতে পুলিশ হন্য হয়ে খোঁজতে থাকে। মোবাইল ট্যাকিংয়ের মাধ্যমে তার অবস্থান জানতে পুলিশ বার-বার চেষ্টা করলে সুজনের অবস্থান সিলেট রেঞ্জের ভিতরে রয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়। ঘাতক সুজনের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ আশ্বস্ত করলে ইমনের পরিবারের লোকজন সিলেটের বিভিন্ন স্থানে তাকে খোঁজাখোঁজি করতে থাকে। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তার সন্ধান করার সময় সকালে কদমতলী বাসষ্ট্যান্ড থেকে কুমিল্লাগামী বাসে উঠার সময় তাকে ঝাপটে ধরে বাতিরকান্দি গ্রামের মৃত আইয়ুব আলীর পুত্র অপহৃত ইমনের মামাতো ভাই আব্দুল আহাদ। পরে সিলেট পুলিশের সহায়তায় তাকে ছাতক থানায় হস্তান্তর করা হয়। অপহৃত শিশু ইমন বাতিরকান্দি গ্রামের সৌদি প্রবাসী জহুর আলীর পুত্র ও লাফার্জের কমিউনিটি বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণীর ছাত্র। অপহরণের ঘটনায় মূল নায়ক মসজিদের ইমাম সুয়েবুর রহমান সুজনসহ এ পর্যন্ত জড়িত সন্দেহে আরো ৫জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশের দু’ফা রিমান্ড : মসজিদের ইমাম সুয়েবুর রহমান সুজন, বাতিরকান্দি গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও জাহেদের দেয়া তথ্য মতে পুলিশ গতকাল শনিবার দুপুরে বাতিরকান্দি হাওড়ে অভিযান চালায় থানা পুলিশ। হাওড়ের বিভিন্ন স্থানে ইমনের মাথার খুলি, চোয়াল ও হাতের হাড় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। ইমনের পিতা জহুর আলী মাথার খুলি ও দাঁতের সারি দেখে তার পুত্রের বলে শনাক্ত করেন। ছাতক থানার ওসি হারুন অর রশীদ চৌধুরী জানান, শিশু ইমন অপহরণের দিন থেকে তাকে উদ্ধারের জন্য প্রাণপনণ চেষ্টা করেছি। অব্যাহত চেষ্টার ফলে অপহরণ ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। এ ঘটনায় জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে।