সন্ত্রাস প্রতিরোধে মহানবী (সা:)’র কৌশল

768

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

সন্ত্রাস বর্তমান সময়ের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সন্ত্রাস। সন্ত্রাস একদিকে যেমন বিশ্ব শান্তিকে হুমকির মুখে দাঁড় করে দিয়েছে অন্যদিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সভ্যতার সৌধকে। বর্তমান বিশ্বে ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে একাকার করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ মানবসভ্যতার শুরুতেই সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে ইসলাম পৃথিবীতে এসেছে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সন্ত্রাসের সাথে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, এর দ্বারা ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠিকে আতঙ্কিত করে তোলা হচ্ছে এবং বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি করা হচ্ছে। অত্র প্রবন্ধে সন্ত্রাস এর সংজ্ঞা, কোরআন ও হাদীসে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ, সন্ত্রাস প্রতিরোধে কোরআন ও হাদীসের নির্দেশনা ও মহানবী (সা.) এর কার্যক্রম বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
সন্ত্রাস এর সংজ্ঞা : সন্ত্রাস একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ বর্তমান মতবিরোধপূর্ণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একপ্রকার অসম্ভবই বটে। কারণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠির দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা যে কোন বিষয় বা মতবাদের সংজ্ঞার ভিন্নতা নির্দেশ করে। তাই তো দেখা যায়, এক গোষ্ঠির দৃষ্টিতে যে কর্মকান্ড সন্ত্রাসের মতো নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত কর্ম, অপর গোষ্ঠির দৃষ্টিতে সে কর্মকান্ডই স্বাধীনতা কিংবা স্বাধিকার আদায় সংগ্রামের মতো মহৎ ও প্রশংসনীয় কর্ম। সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়নে বিতর্ক থাকলেও বক্ষ্যমান আলোচনার উদ্দেশ্য অর্জনের প্রয়োজনে সন্ত্রাসের একটি সু-নির্দিষ্ট পরিচয় নির্ধারণ আবশ্যক।
সন্ত্রাস শব্দটি বাংলা ‘ত্রাস’ শব্দ উদ্ভূত। যার অর্থ ভয়, ভীতি, শঙ্কা। “ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯২, পৃ. ৫৭৩”
আর সন্ত্রাস অর্থ হলো, মহাশঙ্কা, অতিশয় ভয়, “আহমদ শরীফ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬, পৃ. ৫৪১” কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা, অতিশয় শঙ্কা বা ভীতি, “ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১৩’’ অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ, “শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, সংসদ বাংলা অভিধান, কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০০, পৃ. ৮০৪” ভীতিজনক অবস্থা, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক পরিবেশ। “রিয়াজ আহমদ, ব্যবহারিক শব্দকোষ, ঢাকা: সাহিত্য বিলাস, ২০০৮, পৃ. ২৬২” সন্ত্রাস এর সমার্থক শব্দ হিসাবে সন্ত্রাসবাদ, আতঙ্কবাদ, বিভীষিকাপন্থা, সহিংস আন্দোলন, উগ্রপন্থা, উগ্রবাদ, চরমপন্থা ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়। “অশোক মুখোপধ্যায়, সংসদ সমার্থ শব্দকোষ, কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৯৮৮, পৃ. ২৪৭” বর্তমানে সন্ত্রাস কোন বিচ্ছিন্ন কর্মকা- নয়। বর্তমানে এটি একটি মতবাদে পরিণত হয়েছে। তাই সন্ত্রাস ভিত্তিক বা কেন্দ্রিক মতবাদ ও কর্মকান্ডকে বুঝাতে সন্ত্রাসবাদ শব্দটি বহুল প্রচলিত। অভিধানে “সন্ত্রাসবাদ” অর্থ লেখা হয়েছে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠাননীতি, “ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১৩,” রাজনীতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পীড়ন, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক কর্ম অবলম্বন করা উচিত- এই মত। “শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০৪,” ইংরেজীতে সন্ত্রাস অর্থ বুঝাতে ঞবৎৎড়ৎ: মৎবধঃ ভবধ/ধষধৎস ঃবৎৎড়ৎরংস গড়যধসসধফ অষধহফ ড়ঃযবৎং ইধহমষধ অপধফবসু ইধহমষধ-ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু, উযধশধ: ইধহমষধ অপধফবসু, ১৯৯৪, ঢ়. ৭৮৬” বীঃৎবসব ভবধৎ, ঃযব ঁংব ড়ভ ড়ৎমধহরুবফ রহঃরসরফধঃরড়হ ঃবৎৎড়ৎরংস [নধংবফ ড়হ ষধঃরহ ঃবৎৎবৎব ড়ঃড় ভৎরমযঃবহ”, ুওষষঁংঃৎধঃবফ ঙঢঋঙজউ উওঈঞওঙঘঅজণ. খড়হফড়হ: উড়ৎষরহম শরহফবৎংষবু ষরসরঃবফ, ২০০৬. ঢ়. ৮৫৯” শব্দসমূহ ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক আরবি ভাষায় সন্ত্রাস শব্দের প্রতিশব্দ হলো (ইরহাব)। “ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান, ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী, ২০০৯, পৃ. ৭১” এ শব্দটি এসেছে (রাহবুন) থেকে যার অর্থ (খাফ) ভীত হলো, ভয় পেলো ইত্যাদি। “ইবনে মানযুর আল-আফরাকী আল-মিসরী, লিসানুল আরব, বৈরূত: দারুল সাদির, তা.বি.খ. ১, পৃ. ৪৩৬” আর (ইরহাব) অর্থ হলো (তাখভীফ) ও (তাফযী), “ইবরাহীম মুসতাফা ও অন্যান্য, আল-মু’জামুল ওয়াসীত, বৈরূত: দারুল দা’ওয়াহ, তা.বি.খ. ১, পৃ. ৩৭৬: আল-মুনজিদ ফিল লুগাহ, বৈরূত: দারুল মাশারিক, ১৯৯৪, পৃ. ২৮২” তথা ভীতিপ্রদর্শন, শঙ্কিতকরণ, আতঙ্কিতকরণ। “ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান,প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৪, ৩০৩” সন্ত্রাস এর শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থের ব্যাপারে মতানৈক্য তেমন না থাকলেও এর পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণে যথেষ্ট মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। আর এই মতানৈক্যের কারণেই আজ পর্যন্ত সন্ত্রাস এর সর্বসম্মত কোন পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক এষড়নধষ ঃবৎৎড়ৎরংস এর উপর প্রকাশিত ধহহঁধষ ৎবারবি ২০০০ এ বলা হয়েছে যে, ঘড় ড়হব ফবভরহধঃরড়হ ড়ভ ঃবৎৎড়ৎরংস যধং মধরহবফ ঁহরাবৎংধষ ধপপবঢ়ঃধহপব অর্থাৎ সন্ত্রাসের কোন সংজ্ঞা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। “ঞযব এঁধফৎফরধহ ফধঃব:  ৭ গধু, ২০০১” প্রত্যেক মতবাদীরাই নিজ নিজ বিশ্বাস দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়নে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাস কেন্দ্রিক আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে দুইটি প্রধান দর্শন। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের সমন্বয়ে গঠিত পাশ্চাত্য দর্শন। অপরটি ইসলামী দর্শন। তাই সন্ত্রাস এর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ উভয় দর্শন থেকে প্রদত্ত সংজ্ঞাসমূহ উল্লেখ করা হলো।
১। যায়েদ ইবনু মুহাম্মদ ইবনে হাদী আল-মাদখালী বলেন, ‘ইরহাব (সন্ত্রাস) এমন একটি শব্দ বিভিন্ন আঙ্গিকে যার অনেক অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে- নিরপরাধ অন্যায়ভাবে নির্দোষ মানুষকে ভয় দেখানো ও শঙ্কিত করা। কখনো নিরীহ ব্যক্তিবর্গকে হত্যার সীমাহীন ভীতি প্রদর্শন, সুরক্ষিত সম্পদ বিনষ্ট বা লুট, সধ্বী-সাধবী নারীর সম্ভ্রমহানি করা। “প্রফেসর ফাহাদ ইবনে ইবরাহীম আবুল উসারা, লামহাত আনিলি ইরহাবি ফিল আসরিল হাযির, সউদী আরব: জামি’আ আল-ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাউদ আল-ইসলামিয়্যাহ, ২০০৪, পৃ. ৫” ২। আল-মাওসূ’আহ আল-আরাবিয়্যাহ আল-‘আলামিয়্যাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইরহাব (সন্ত্রাস) হচ্ছে ভীতি সঞ্চারের জন্য বল প্রয়োগ করা অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করা। “আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লা, আল-ইরহাব আসবাবুহু ওয়া ওয়ায়িদুল ইলাজ, মাজাল্লাতুল বুহুছ আল-ইসলামিয়্যাহ, সউদী আরব: কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, ২০০৩ সংস্যা-৭০ পৃ. ১০৮-১০৯” ৩। রাবিত্বাতুল আলামিল ইসলাম’ পরিচালিত ‘ইসলামী ফিক্বহ কাউন্সিল’  ১৪২২ হিজরীতে মক্কায় অনুষ্ঠিত ১৬তম অধিবেশনে সন্ত্রাসের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা নির্ধারণ করে, কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র কোন মানুষের ধর্ম, বুদ্ধিমত্তা, সম্পদ ও সম্মানের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যে শত্র“তার চর্চা করে তাকে সন্ত্রাস বলে”। এ সংজ্ঞা সব ধরণের নীতিবহির্ভূত ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন, ক্ষতিসাধন, অন্যায় ও বিচার বহির্ভূত হত্যা, অপরাধমূলক হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে একক ও সমষ্টিগতভাবে পরিচালিত যে কোন ধরণের অন্যায় কর্ম, সশস্ত্র হামলা, চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, রাহাজানি, ভীতিকর ও হুমকিপূর্ণ কাজ এবং এবং লোকজনের জীবন, স্বাধীনতা, নিরাপত্তাকে বিঘিœত করে, জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে এমন কর্মকান্ডকে শামিল করে। তাছাড়া পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ও জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট বা প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করাও সন্ত্রাস হিসাবে গণ্য হবে। “প্রফেসর ফাহাদ ইবনে ইবরাহীম আবুল উসারা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫”। ৪। ১৯৮৯ সালে আরব দেশসমূহের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ প্রদত্ত সংজ্ঞা হচ্ছে- সহিংসতা সৃষ্টিকারী বা হুমকি-ধমকি প্রদানকারী এমন সব কাজ যা দ্বারা মানবমনে ভীতি-আতঙ্ক, ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি হয়। তা হত্যাকান্ড, ছিনতাই, অপহরণ, গুপ্তহত্যা, পণবন্দী, বিমান ও নৌজাহাজ ছিনতাই বা বোমা বিস্ফোরণ প্রভৃতির যে কোনটির মাধ্যমে হোক না কেন। এছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংঘটিত যেসব কাজ ভীতিকর অবস্থা ও পরিবেশ, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে (তাও সন্ত্রাস)”। “ড. আব্দুর রহমান ইবনে মু’আল্লা আল-লুয়াইহিক, আল- ইরহাব ওয়াল-গুলু, জামি’আহ আল-ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ আল- ইসলামিয়্যাহ, ২০০৪, পৃ. ১৩” “৫. ইৎরঃধহহরপধ জঊঅউণ জঊঋঊঘঈঊ ঊঘঈণঈখঙচঊউওঅ তে সন্ত্রাস- এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ঞবৎৎড়ৎরংস ঃযব ংুংঃবসধঃরপ ঁংব ড়ভ ারড়ষবহপব ঃড় পৎবধঃব ধ মবহবৎধষ পষরসধঃব ড়ভ ভবধৎ রহ ধ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ধহফ ঃযবৎবনু ঃড় নৎরহম ধনড়ঁঃ ধ ঢ়ধৎঃরপঁষধৎ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ড়নলবপঃরাব. ইৎরঃধহহরপধ জঊঅউণ জঊঋঊজঊঘঈঊ ঊঘঈণঈখঙচঊউওঅ, ঘবি ফবষযর: ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ইৎরঃধহহরপধ (ওহফরধ) চাঃ. খঃফ ধহফ ওসঢ়ঁষংব গধৎশবঃরহম,) ঝঢ়বপরধষ বফরঃরড়হ ভড়ৎ ংড়ঁঃয অংরধ, ২০০৫, ঠড়ষঁসব- ৯, ঢ়. ২২৩”
একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করার সুসংগঠিত পন্থাই হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ”। ৬. মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ঋইও সন্ত্রাসকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে, ঞযব ঁহষধভিঁষ ঁংব ভড়ৎপব ধহফ াধষবহপব ধমধরহংঃ ঢ়বৎংড়হং ড়ভ ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃু ঃড় রহঃরসরফধঃব ড়ৎ পড়বৎপব ধ মড়াবৎহসবহঃ, ঃযব পরারষরধহ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ, ড়ৎ ধহু ংবমসবহঃ ঃযবৎবড়ভ, রহ ভঁৎঃযবৎধহপব ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ড়ভ ংড়পরধষ ড়নলবপঃরাবং (২৮. ঈ.ঋ.জ. ঝবপঃরড়হ ০.৮৫) িি.িভনর.মড়া/ংঃধঃং-ংবৎারপবং/ঢ়ঁনষরপধঃরড়হং/ ঃবৎৎড়ৎরংস-২০০২-২০০৫”
অর্থাৎ- সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোন সরকার, বেসকারি জনগণ বা অন্য যে কোন অংশকে ভীতি প্রদর্শন বা দমনের জন্য ব্যক্তিবর্গ বা সম্পদের উপর অবৈধ শক্তি প্রয়োগ বা সহিংস ব্যবহারকে সন্ত্রাস বলা হয়।
যে কর্মকান্ড সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জান-মালের ক্ষতি সাধন, দেশ ও সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি, শান্তি ও নিরাপত্তা ক্ষুণœ, স্থাপনা ও স্থাপত্য ধ্বংস এবং সর্বস্তরের নাগরিকদের আতঙ্কিত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে তাকে বলা হয় সন্ত্রাস। মোটকথা যে কর্মকান্ড জনগণের মাঝে ভয়-ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি করে এবং জানমালের ক্ষতি সাধন করে তাই সন্ত্রাস এবং যে বা যারা এ সকল কর্মকান্ডের সাথে জড়িত তারাই সন্ত্রাসী।
কোরআনে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ : ইসলামী আইনের প্রধান উৎস আল-কুরআনুল কারীমে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ দুইভাবে এসেছে: শাব্দিক অর্থে ও পারিভাষিক অর্থে। সন্ত্রাস-এর আরবী প্রতিশব্দ ‘ইরহাব’ কে ভিত্তি ধরে শাব্দিক অর্থ হলো- প্রথমত: আল্লাহকে ভয় করা অর্থে এর শব্দমূলের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যেমন: আল্লাহ বলেন: “মূসার ক্রোধ যখন প্রশমিত হলো তখন সেগুলো তুলে নিলো। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য তাতে যা লিখিত ছিল মধ্যে ছিল পথনির্দেশ ও রহমত।” “আল-কুরআনুল,৭: ১৫৪” অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন: “হে বনী ইসরাঈল! আমার সেই অনুগ্রহকে তোমরা স্মরণ কর যা দ্বারা আমি তোমাদেরকে অনুগৃহীত করেছি এবং আমার সঙ্গে তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর।” “আল-কুরআনুল, ২: ৪০।” আল্লাহ অপর এক আয়াতে উল্লেখ আছে, “আল্লাহ বললেন, তোমরা দুই ইলাহ গ্রহণ কর না; তিনিই তো একমাত্র ইলাহ। সুতরাং আমাকেই ভয় কর”। “আল-কোরআন, ১৬: ৫১।”
দ্বিতীয়ত: মানুষকে ভয় দেখানো বা সন্ত্রাস করা অর্থেও ইরহাব (ইরহাব) শব্দের সরাসরি ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন: “তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত্র করবে আল্লাহর শত্র“কে, তোমাদের শত্র“কে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে শত্র“কে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।” “আল-কোরআন, ৮:৬০।”
সামান্য পরিবর্তিত ফর্মে শব্দটি ব্যবহার করে আল্লাহ অন্যত্র বলেন: “সে (মূসা) বলল, তোমরাই নিক্ষেপ কর। যখন তারা (যাদুকররা রজ্জু ও লাঠি) নিক্ষেপ করল তখন তারা লোকের চোখে জাদু করল, তাদেরকে আতংকিত করল এবং তারা এক রকমের জাদু দেখালো।” “আল-কোরআন, ৭: ১১৬।”
প্রচলিত অর্থে সন্ত্রাস বলতে যা বুঝায় তা প্রকাশের জন্য ইরহাব শব্দের ব্যবহার কোরআনে পাওয়া যায় না। সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বুঝানোর জন্য কোরআনে ‘ফিতনাহ’ এবং ‘ফাসাদ’ শব্দদ্বয়ের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সীরাত বিষয়ক উর্দু বিশ্বকোষ ‘নুকুশ’ এর বর্ণনা নিম্নরূপ; “পবিত্র কোরআন গভীরভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণা করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আব্র“, ঈমান, কায়-কারবার ইত্যাদি যার কারণে হুমকি ও বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয় তা-ই হলো ‘ফিতনা’ এবং যার কারণে মানুষের জীবনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, তা-ই হলো ‘ফাসাদ’।” “মো: মুখলেছুর রহমান, সন্ত্রাস নয়, শান্তি ও মহানুভবতার ধর্ম ইসলাম, ঢাকা: এন আরবি গ্র“প, ২০১১, পৃ. ১৫।”
আল-কোরআনে ‘ফিতনা’ প্রসঙ্গ : আল-কোরআনে ‘ফিতনা’ শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব আয়াতে ‘ফিতনা’ কে সন্ত্রাস কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো-
১। আল্লাহ অস্বীকার করা, তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করা, ইবাদতে বাধা প্রদান ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ফিতনার অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ বলেন, “পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে। বল, তাতে যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে বাধা দান করা, আল্লাহকে অস্বীকার করা, মসজিদুল হারামে (প্রবেশে) বাধা দেয়া এবং তার বাসিন্দাকে তা হতে বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকট তদপেক্ষা অধিক অন্যায়; ফিতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, নির্যাতন) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অন্যায়।” “আল-কোরআন, ২: ২১৭”
২। দুর্বলের উপর অত্যাচার করা, তাদের ন্যায্য অধিকার হরণ করা, তাদের ঘর-বাড়ি জবরদখল করা এবং তাদের বিভিন্ন পন্থায় কষ্ট দেয়াও ফিতনার আওতাভুক্ত। আল্লাহ বলেন: “যারা নির্যাতিত হওয়ার পর হিজরত করে, অতঃপর জিহাদ করে এবং ধৈর্য ধারণ করে, তোমার প্রতিপালক এসবের পর, তাদের প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। “আল-কোরআন, ১৬:১১০।”
জবরদস্তিমূলক সত্যকে দমন করা এবং সত্যগ্রহণ থেকে মানুষকে বাধা দেয়। আল্লাহ বলেন: “ফির‘আউন ও তার পারিষদবর্গ নির্যাতন করবে এই আশংকায় মূসার সম্প্রদায়ের এক দল ব্যতীত আর কেউ তাঁর প্রতি ঈমান আনে নাই। বস্তুত ফির‘আওন ছিল দেশে পরাক্রমশালী এবং সে অবশ্যই সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” “আল-কোরআন, ১০: ৮৩।”
৪। মানুষকে বিভ্রান্ত করা, বিপথে চালিত করা এবং সত্যের বিরুদ্ধে প্রতারণা, ধোঁকা, বিশ্বাসঘাতকতা ও বল প্রয়োগের চেষ্টা করা। আল্লাহ বলেন: “আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি তা হতে তারা পদঙ্খলন ঘটানোর চেষ্টায় প্রায় চূড়ান্ত করেছিল যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে তার বিপরীত মিথ্যা উদ্ভাবন কর; তবেই তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতো”। “আল-কোরআন, ১৭: ৭৩।”
৫। বিশ্বাসীদের বিপদে ফেলা। আল্লাহ বলেন: “যারা বিশ্বাসী নর-নারীদেরকে বিপদাপন্ন করেছে এবং পরে তাওবা করেনি তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে দহন যন্ত্রণা”। “আল-কোরআন, ৮৫: ১০”
৬। অসত্যের প্রতিষ্ঠা, অসৎ ও অবৈধ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুদ্ধ, হত্যা ও রক্তপাত করা। আল্লাহ বলেন: “যদি বিভিন্ন দিক হতে তাদের বিরুদ্ধে শত্র“দের প্রবেশ ঘটত, অতঃপর তাদেরকে বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত করা হতো, তবে তারা অবশ্য তাই করত, তারা এতে কালবিলম্ব করত না।” “আল-কোরআন, ৩৩: ১৪।” আল-কুরআনুল কারীমে ‘ফাসাদ’ শব্দটি বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যে সব আয়াতে ‘ফাসাদ’ শব্দকে সন্ত্রাসের কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।
১। অন্যায় শাসন ও হত্যাকান্ড, দুর্বলদের প্রতি অবিচার ও সম্পদ লুটপাট করা। আল-কোরআনে আল্লাহ ফির‘আউনকে ‘ফাসাদ’ সৃষ্টিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, কারণ সে তার প্রজাদের মাঝে শ্রেণী ও বর্ণগত পার্থক্য সৃষ্টি করতো এবং স্বৈরাচারী শাসন চালাতো, দুর্বলদের ও বিরোধীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করতো এবং তাদের সম্পদ লুট করতো।
আল্লাহ বলেন: “ফিরআউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানের অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল করেছিল; তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত থাকতে দিত। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।” “আল-কোরআন, ২৮:৪” (চলবে)