কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তৃত এলাকা দখল করে নিজেদের হুকুমত (খেলাফত) কায়েম করার পর জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) এর নজর এখন মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী আরবশাহী সৌদি আরবের দিকে।
সম্প্রতি এক অডিও বার্তায় সৌদি আরবের শাসকদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য নিজের অনুসারীদের পাশাপাশি সৌদি নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদি।
গত বৃহস্পতিবার প্রচারিত ওই অডিও বার্তায় সৌদিআরব সহ পাঁচটি আরব রাষ্ট্রে নিজেদের খেলাফতের আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের প্লেন হামলায় বাগদাদি নিহত বা আহত হয়েছেন এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ১৭ মিনিটের এই অডিও বার্তা প্রকাশ করে আইএস।
অডিও বার্তায় বাগদাদি বলেন, সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন হামলা ব্যর্থ হয়েছে। তারা এখন ভীতসন্ত্রস্ত ও দুর্বল। আমরা ইসলামিক স্টেটের সীমানা নতুন কয়েকটি দেশে বাড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছি। এগুলো হল- হারামাইন (সৌদি আরব), ইয়েমেন, মিসর, লিবিয়া ও আলজেরিয়া।
সৌদি আরবের (হারামাইন) নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বাগদাদি বলেন, ও হারামাইনের সন্তানরা… সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা ও রোগ ছড়িয়ে পড়েছে… তোমার তলোয়ার উঠাও ও আঘাত করো।
পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরী আল-হারামাইন হিসেবে পরিচিত।
বাগদাদির এই ভিডিও বার্তায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে গ্র“পের প্রধান লক্ষ্য এখন সৌদি আরব। ইসলামের জন্মস্থান এবং একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদন ও রপ্তানিকারক হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই দেশটির ওপর নজর আইএসের। তার ওপর আইএস যে ধর্মীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করে দেশটির অধিকাংশ জনগণ সেই ওয়াহাবি মতবাদের সমর্থক।
তাই সৌদি আরবে আইএসের চ্যালেঞ্জ মূলত দেশটির দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা রাজতান্ত্রিক আল সউদ পরিবারের বিরুদ্ধে।
ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল করে নিজেদের হুকুমত ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন বিরুদ্ধে শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ওই হুকুমত ভালোভাবেই টিকিয়ে রাখতে পেরেছে আইএস।
এখন ওই সক্ষমতায় উজ্জীবিত হয়েই আইএস চায় ইসলামের কেন্দ্রস্থল এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে লোভনীয় তেল সমৃদ্ধ সৌদি আরব সহ আশেপাশের আরবশাহীগুলোকে কব্জা করতে।
গত গ্রীষ্মে যখন নিজেদের দখলিকৃত ভূখণ্ডে খেলাফত কায়েমের ঘোষণা দেয় আইএস, পরবর্তী দৃষ্টি যে তাদের তেল সমৃদ্ধ আরবশাহীগুলো, তা ছিলো অনেকটাই পরিষ্কার। আর তাদের মনোযোগের মূল কেন্দ্রবিন্দু এখন আরবশাহীর ক্ষমতার উৎস সৌদি আরব।
এ পরিস্থিতিতে মহা আতঙ্কিত সৌদি আরবের বর্তমান শাসক চক্র। বিশেষ করে অডিও বার্তায় সরাসরি সৌদি আরবকে চ্যালেঞ্জ করায় এখন প্রমাদ গুণছেন সৌদি আল সউদ পরিবার।
শুধু তেলের কারণে সৌদি আরব আইএসের জন্য লোভনীয় নয় বরং ইসলামের জন্মস্থান এ পবিত্র ভূমির দুই পবিত্র নগরীকেও নিজেদের খেলাফতের অধীনে নিয়ে আসাটাও জঙ্গি গ্র“পটির অন্যতম অভিষ্ট লক্ষ্য।
আইএস এর এই দুরভিসন্ধি আঁচ করতে পেরে ইতোমধ্যেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএস বিরোধী কোয়ালিশনের অংশ হিসেবে সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের আস্তানা লক্ষ্য করে চালানো প্লেন হামলায় অংশ নিয়েছে সৌদি আরব। আর এই হামলায় অংশ নেন স্বয়ং সৌদি আরবের এক রাজপুত্র।
পাশাপাশি প্লেন আক্রমণে এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের ককপিটে প্রিন্স খালেদ বিন সালমানের ছবি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় সৌদি রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমে।
এছাড়া আল সউদ পরিবারের বেতকভুক সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতিও আইএসকে ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্র“ হিসেবে ফতোয়া দিয়েছেন। ফতোয়ায় গ্রান্ড মুফতি শেইখ আব্দুল আজিজ আল-শেইখ ‘জালিম’ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএলকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান।
কিন্তু আইএসের বিরুদ্ধে সৌদি রাজতন্ত্রের এই অবস্থান বদলকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না তাদের নিজের দেশের কট্টরপন্থিরাই।
আসলে মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বজুড়ে ইরানের নেতৃত্বে শিয়া প্রভাব বিস্তারকে ভালো চোখে দেখছেন না সৌদি ওয়াহাবিরা। বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে শিয়া উত্থানের মোকাবেলায় সৌদি আরবের শাসক চক্রের মেরুদণ্ডহীনতায় আল সউদ পরিবারের ওপর তারা ক্ষুব্ধ। এ পরিস্থিতিতে কট্টর সৌদি নাগরিকদের কাছে আল সউদ পরিবারের বিকল্প আবেদন আইএস। তাই দলে দলে তারা সামিল হচ্ছেন আইএসের পতাকাতলে।
ধারণা করা হচ্ছে, এ মুহূর্তে আইএসের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছেন ২ হাজারেরও বেশি সৌদি নাগরিক।
সর্বোপরি ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাক জুড়ে ইরানের নেতৃত্বাধীন ‘শিয়া ক্রিসেন্ট’ ঠেকাতে সৌদি রাজতন্ত্রের বদলে এখন আইএসের প্রতিই আস্থাশীল কট্টর ওয়াহাবিরা।
তাছাড়া দ্রুতগতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীকে পরাভূত করে ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল এবং সে সব অংশে নিজেদের শাসন কায়েম করার মধ্য দিয়ে সমর্থকদের মধ্যে নিজেদের যোগ্যতাও প্রমাণ করেছে জঙ্গি সংগঠনটি।
সৌদি আরবের ওয়াহাবিদের কাছে জঙ্গি আইএস যতটা না ভীতিকর তার থেকে বেশি অসহ্য শিয়া ইরানের আধিপত্য। এ পরিস্থিতিতে ইরানকে ঠেকাতে তারা বেছে নিচ্ছে আইএসকেই।
যদি আসলেই আইএস কার্যকরভাবে সৌদি আরবে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারে সেক্ষেত্রে একই মতাদর্শের কারণে হলেও সৌদি ওয়াহাবিরা মেরুদণ্ডহীন আল সউদ পরিবারের বদলে বেছে নিতে পারে আইএসকে।
পাশাপাশি আইএস ছাড়াও ঘরে বাইরে বিপদের সামনে সৌদি আরবের আল সউদ পরিবার।
দক্ষিণাঞ্চলের পারস্য উপসাগর সংলগ্ন তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলে বসবাসকারী শিয়ারা ইরানের মদদে প্রায়ই মাথাচাড়া দিচ্ছে।
ইরাকেও সৌদি রাজতন্ত্রকে সমঝোতা করতে হচ্ছে এমন একটি সরকারের সঙ্গে ইরানের সঙ্গে যাদের দহরম মহরম অনেকটাই প্রকাশ্য।
আবার ঘরের আঙ্গিনা ইয়েমেনে ইরানের মদদে শিয়া হুথিরা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তাদের প্রভাবের সামনে ম্লান ইয়েমেনের সৌদি মিত্ররা। ফলে বাধ্য হয়েই হুথিদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হচ্ছে সৌদি আরবকে।
ফলে ইয়েমেনে সুন্নিদের মাঝে বেড়ে গেছে কট্টরপন্থি জঙ্গি সংগঠনগুলোর জনপ্রিয়তা। সরকার ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম স্বীকার না করলেও ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় এবং উত্তরের অনেক প্রদেশ এখন আল কায়েদার নিয়ন্ত্রণে।
লেবাননেও শিয়া জঙ্গি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর শক্তি ও প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
লেবাননের বর্তমান সরকারকে সৌদি আরবকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা দিলেও দেশটির দুর্বল সরকারের ওপর সহজেই চোখে পড়ে হিজবুল্লাহর প্রভাব।
এ পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ সৌদি আরবের সাধারণ জনগণ। শিয়া আগ্রাসনের সামনে তারা নিজেদের দেখছে অসহায় অবস্থায়। আর একই মতাদর্শের কারণে তাদের চোখে এখন ত্রাতা হিসেবে ধরা দিচ্ছে আইএস।
সম্প্রতি কোয়ালিশনের বিমান হামলায় সিরিয়া ও ইরাকে আইএস জঙ্গিরা ছাড়াও মারা গেছেন অনেক সাধারণ সুন্নি বেসামরিক মানুষ। এই বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না ওয়াহাবিরা।
তাদের চোখে, কোয়ালিশনের বিমান হামলা ক্যাম্পেইন শেষ পর্যন্ত সুবিধা এনে দিচ্ছে আরব সুন্নিদের চরম শত্র“ ইরানকে। তাদের মতে, পশ্চিমা বিশ্ব ও সৌদি আরব আইএসকে বাগদাদ ও দামেস্কে মার্চ করা থেকে বিরত রেখে কার্যত লাভ করে দিচ্ছে ইরানকে।
সৌদি আরবের অধিকাংশ নাগরিক এমনকি যারা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ তারাও বিশ্বাস করেন না ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস অবস্থানে বোমা বর্ষণ সেদেশের সুন্নিদের স্বার্থ রক্ষা করবে। বরং তারা নিজেদের দেশকে দেখছে ইরানের প্রক্সি বিমান বাহিনী হিসেবে।
এ পরিস্থিতিতে আল সউদ পরিবারের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে আইএসের খেলাফতের অধীনস্থ হতে সৌদি নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে জঙ্গি সংগঠন আইএস। সৌদি আরবের কট্টর ওয়াহাবিরা যারা একই সঙ্গে পশ্চিমাদের সঙ্গে আল সউদ পরিবারের মিত্রতার কারণে ক্ষুব্ধ তাদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা বাড়ছে আইএসের।
আইএসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখার বদলে তাদের সুন্নি ইসলামের সাহসী সুরক্ষাকারী হিসেবে দেখা শুরু করেছে ওয়াহাবিরা। তাদের চোখে আইএস এখন সেই শক্তি যারা ইরান ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শিয়া জোটের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
সব মিলিয়ে সীমান্তের চারপাশে একই সঙ্গে অনেকগুলো সমস্যা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে এ মুহূর্তে অনেকটাই গলদঘর্ম সৌদি আরবের বিলাসী বাদশাহ ও আমির ওমরাহরা।
পাশাপাশি সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের শীর্ষ পর্যায়ে এখন বয়োবৃদ্ধদের ভিড়। সিংহাসনের সম্ভাব্য উত্তরাধিকাররা প্রত্যেকেই বয়োবৃদ্ধ, অকর্মণ্য এবং ভোগী। তাছাড়া তাদের নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাসও ব্যাপক। তাই ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রও এ মুহূর্তে পদে পদে বিব্রত করছে সৌদি রাজতন্ত্রকে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সৌদি শাসকরা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলোর পরামর্শক এবং ভাড়াটে উপদেষ্টাদের ওপর। তাদের বেশিরভাগই আবার ওই দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত।
মধ্যপ্রাচ্যের হিসাব কষার সময় এসব পরামর্শক যতটা না সৌদি বাদশাহীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে তার থেকে বেশি প্রাধান্য দেবে নিজেদের দেশের স্বার্থকে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সৌদি রাজতন্ত্রের স্বার্থের প্রতিকূলে যায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেও দ্বিধা করবে না তারা।
এমনকি অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষকের মতে আইএস ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমাদের সঙ্গে ইরান ও সিরিয়ার জোট গঠন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সম্প্রতি ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানির সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের বৈঠকটি সে বিষয়টিই ইঙ্গিত দেয়।
বৃহত্তর হুমকি আইএস ঠেকাতে প্রয়োজনে সৌদি আরবের বর্তমান রাজতন্ত্রকেও ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে সাবেক মিত্রদের ছুঁড়ে ফেলার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বের এসব কট্টরপন্থি ওয়াহাবি জঙ্গিদের দুধ কলা দিয়ে এতদিন পুষে আসছিলো সৌদি আরব সহ উপসাগরীয় আরবশাহী দেশগুলোই।
পাকিস্তান, আফগানিস্তান সহ মুসলিম বিশ্বের যে সব মাদ্রাসায় সহিংস জিহাদের পাঠ দেয়া হয় তাদের তহবিল যোগায় মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশই। এসব মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা ছাত্ররাই কট্টর ওয়াহাবি মতবাদে উদ্বুদ্ধ্ব হয়ে আদর্শ হিসেবে এখন মানছে আইএস এর মত কট্টর জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে।
এ পরিস্থিতিতে নিজেদের গড়া ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবই এখন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরবের শাসককূলের জন্য।
আইএস নামের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের এই দানবের হাত থেকে সৌদি রাজতন্ত্র কিভাবে রক্ষা পায় তাই এখন দেখার বিষয়।