মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ গড়েছেন ৩, ৬০৪ বাংলাদেশি

4

কাজির বাজার ডেস্ক

মালয়েশিয়ায় ‘দ্বিতীয় নিবাস’ গড়ায় বাংলাদেশিদের অবস্থান ওপরের দিকেই রয়েছে। মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএম২এইচ) কর্মসূচির মাধ্যমে দেশটিতে দ্বিতীয় নিবাস গড়েছেন ৩ হাজার ৬০৪ বাংলাদেশি।
সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ৫৮ হাজার ৪৬৮ জন নাগরিক মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। এরমধ্যে ৩ হাজার ৬০৪ বাংলাদেশিও রয়েছেন।
রোববার (৮ মার্চ) দেশটির পর্যটন, শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী দাতুক সেরি তিওং কিং সিন এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএম২এইচ) কর্মসূচিটি বিশ্বের যেকোনো দেশের আবেদনকারীর জন্য উন্মুক্ত বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।
মন্ত্রী বলেন, এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিদেশীরা বিভিন্ন যোগ্যতার মানদÐের অধীনে মালয়েশিয়ায় বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারবেন এবং যারা সফল হবেন তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসবাসের পাস পাবেন।
এর আগে, গত ২৪ ফেব্রæয়ারি মন্ত্রী সংসদে বলেন, মোট অনুমোদনের মধ্যে ৫৭ হাজার ৬৮৬টি পূর্বের নীতির আওতায় দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ২৮ হাজার ২০৯ জন মূল আবেদনকারী এবং ২৯ হাজার ৪৭৭ জন ডিপেন্ডেন্ট রয়েছেন। তবে কোন দেশের কতজন, তা উল্লেখ করেননি তিনি।
আরেক বিবৃতিতে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দেশটিতে ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৬৬ জন অ্যাকটিভ সেকেন্ড হোম পাস হোল্ডার রয়েছেন। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৭৬৫ জন পাসধারী নিয়ে শীর্ষে রয়েছে চীন। এরপরে যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়ার ৪ হাজার ৯৪০ জন, জাপানের ৪ হাজার ৭৩৩ জন এবং বাংলাদেশের ৩ হাজার ৬০৪ জন।
মন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন নীতির আওতায় এখন পর্যন্ত ৭৮২টি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৩১৯ জন মূল আবেদনকারী এবং ৪৬৩ জন ডিপেন্ডেন্ট।
তিনি আরও জানান, নতুন শর্তাবলীর অধীনে অনুমোদিত মাই সেকেন্ড হোম পাসধারীদের কাছ থেকে আনুমানিক ২৩৩.৮ মিলিয়ন রিঙ্গিত স্থায়ী আমানত এবং ২২২ মিলিয়ন রিঙ্গিত রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ এসেছে।
২০২৩ সালের জুন মাসে এই কর্মসূচির জন্য সর্বশেষ নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়। যেখানে ৩টি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়- সিলভার, গোল্ড ও প্লাটিনাম।
এছাড়াও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং এর জন্য একটি বিশেষ ক্যাটাগরি সংযোজন করা হয়। নতুন নীতির অধীনে এই কর্মসূচি কেবল মালয়েশিয়ার সঙ্গে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক থাকা দেশের নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং আবেদনকারীর ন্যূনতম বয়স হতে হবে ২৫ বছর এবং প্রতি বছর অন্তত ৯০ দিন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করতে হবে।
প্লাটিনাম ক্যাটাগরির জন্য ১০ লাখ মার্কিন ডলার, গোল্ড ক্যাটাগরির জন্য ৫ লাখ মার্কিন ডলার এবং সিলভার ক্যাটাগরির জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার স্থায়ী আমানত হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া আবেদনকারীদের মালয়েশিয়ায় ৬ লাখ রিঙ্গিত থেকে ২০ লাখ রিঙ্গিত মূল্যের সম্পত্তি কিনতে হবে। যা নির্ভর করবে তাদের বেছে নেওয়া ভিসা ক্যাটাগরির ওপর।
জরিপ বলছে, গত ৭ বছরে বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৪ গুণ। দেশটিতে বাস করা বাংলাদেশি ও নানা মহলের কাছ থেকে জানা গেছে, সেকেন্ড হোম করতে যে টাকার প্রয়োজন হয়, তা বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি বলেন, মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোমের জন্য ব্যবসায়ীদের অনেক সুবিধা দেয়। কেউ দেশের ‘আনরেস্ট’ থেকে বাঁচতে, আবার কেউ তার সম্পদ সরাতে সেকেন্ড হোমের আশ্রয় নিয়েছেন। ওখানে একজন বাংলাদেশি ব্যক্তি গড়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করলেই সেকেন্ড হোমের সুবিধা পান।
এক প্রবাসী বাংলাদেশি বলেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি এলাকা গড়ে উঠেছে। সেখানকার অধিবাসীরা ফ্ল্যাট কিনে থাকছেন। আর এখানে ফ্ল্যাটের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়েও কম। কেউ কেউ বাড়ি কিনেছেন ও ফ্ল্যাট কিনেছেন। মালয়েশিয়ার শিক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম বনানোর আরেকটি কারণ।
ঠিক কোন শ্রেণির লোক মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন, সে ব্যাপারে কোনো গবেষণা নেই। তবে যারা এটা করছেন তাদের কেউই সাধারণ পর্যায়ের লোক নন। তাদের অর্থ এবং ক্ষমতা আছে, তারা ব্যবসায়ীও হতে পারেন। আর বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদই ব্যবসায়ী।
মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোমের বিষয়ে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করে না। বিনিয়োগের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করে না। বাংলাদেশে একটা ফ্ল্যাট কিনলে অর্থের উৎস জানাতে হয়। তাই বাংলাদেশে যাদের অবৈধ আয় আছে বা যারা অর্থের উৎস জানাতে অক্ষম, তারা মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন আর হুন্ডির মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার করছেন।
তবে কেউ কেউ আছেন যারা বৈধভাবেও এটা করছেন। কিন্তু এতে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। যে অর্থ দেশে বিনিয়োগ হতে পারত, তা বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন। অনেকেই বলছেন, মালয়েশিয়া সরকার টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করায় বাংলাদেশিরা এই সুযোগ নিচ্ছেন।
এদিকে মালয়েশিয়াতে কয়েক হাজার বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের ব্যবসা গড়েছেন। ওই দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পাঁচতারা হোটেল ব্যবসা, গার্মেন্ট কারখানা, ওষুধ শিল্পসহ নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অনেকে রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ বড় বড় শপিংমলে দোকানও কিনেছেন। অনেকে স্বর্ণ, খেলনা, তৈরি পোশাকের ব্যবসা করছেন।
এদের কেউই বৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই তারা মালয়েশিয়াতে টাকা নিয়ে গেছেন। অনেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন দেশটির কৃষি খাতসহ বিভিন্ন খাতে।
এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্সের সদস্য ডা. শংকর পোদ্দার বলেছেন, যারা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে যুক্ত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই নিজের ও বিনিয়োগের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যুক্ত হয়েছেন।
ডা. শংকর বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। কেনো নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস করতে যাচ্ছে মানুষ। আর মালয়েশিয়া আমাদের জন্য যা করতে পারছে, আমরা কেনো তা পারছি না।
তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ কবে অন্য দেশের মানুষের সেকেন্ড হোম হবে, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য এখন পর্যন্ত সামান্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের তথাকথিত সেকেন্ড হোম তৈরি করা, সিঙ্গাপুরের তারকা হোটেলের মালিকানা নেওয়া ও সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা এমন বিষয় অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে।
অভিযোগ আছে, দেশ থেকে পাচার করা অর্থই এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে বাংলাদেশিদের অবস্থান একসময় ছিল তৃতীয়; এবার ৪র্থ স্থানে নেমে এসেছে।
এর আগে সরকার নামমাত্র করের বিনিময়ে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনার সুযোগ দিয়েছিল। তবে সেই সুযোগ কেউ নেননি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের উচিত আইনের প্রয়োগ বাড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার রোধ করা।