জামায়াতের আমীর ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, ৫ আগস্টের গণঅভ‚্যত্থানের ক্রেডিট কোন দলের নয়, এর ক্রেডিট শুধু ছাত্র-জনতার। ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছে। যদিও এর পেছনে আমাদের অনেক শহীদের ত্যাগ রয়েছে। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন মেধাবী সেনা অফিসারের ত্যাগ দিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৫ আগস্ট হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের পতনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশে একটি সাময়িক পরিবর্তন হয়েছে। একে স্থায়ী রুপ দিতে হলে প্রয়োজন সৎলোকের শাসন ও আল্লাহর আইন। যেখানে দল-মতের উর্ধ্বে সকল নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে। আমরা কাজের মাধ্যমে দেশবাসীর প্রকৃত ভালোবাসা অর্জন করতে চাই। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু ভেদাভেদ চাইনা। এমন সমাজ গঠন করতে চাই যেখানে মসজিদের মতো মন্দিরেও পাহারার প্রয়োজন হবেনা। যদি কেউ আমাদের সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায় তাহলে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের রুখে দিতে হবে। দেশকে ভালবাসতে হলে প্রথমে নিজেকে বদলাতে হবে।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি বৈঠার তান্ডবে মানুষ হত্যার উল্লাসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল। সেই বাংলাদেশ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আবার পথে ফিরেছে। আমাদের ছাত্র ও যুবসমাজ সেই অসাধ্য সাধন করেছে। আমরা দেখেছি নিজের বড় কোন সন্তান না থাকায় একজন মা দেড় বছরের কোলের শিশুকে নিয়ে রাজপথে নেমেছেন। ৭০ বছরের বৃদ্ধও শাহাদাতের তামান্না নিয়ে রাজপথে ছিলেন। যে জাতির দেড় বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধরা রাজপথে নামতে পারেন সেই জাতিকে আর দমিয়ে রাখা যাবেনা।
তিনি শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টায় দক্ষিণ সুরমার কুশিয়ারা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হলে সিলেট মহানগর জামায়াত আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপরোক্ত কথা বলেন। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগরী আমীর মুহাম্মদ ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে, সেক্রেটারী মোহাম্মদ শাহজাহান আলীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মহানগরীর কয়েক হাজার কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে কর্মী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সিলেট মহানগর জামায়াতের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। বেলা ৩টার আগেই কুশিয়ারা কনভেনশন হলের ভেতর লোকে লোকারণ্য হয়ে। উপস্থিত কর্মীদের জন¯্রােতে এক সময় হলের বাহিরও কানায় কানায় পরিপুর্ণ হতে দেখা গেছে।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমান, জেলা উত্তরের আমীর হাফিজ আনওয়ার হোসাইন খান, জেলা দক্ষিণের আমীর অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা: শফিকুর রহমান বলেন, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশী মজলুমের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা আমাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসি দিয়ে শহীদ করেছে। আজ তারা ইতিহাসের মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আমাদের ২ শীর্ষ নেতা দুটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ২টাকারও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেনি। কারণ তারা আল্লাহর জমিনে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতা ছিলেন। জামায়াত এমন নেতৃত্ব উপহার দিতে চায়। সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করতে চায়। এজন্য প্রয়োজন একদল ঈমানদার সুনাগরিক। চুড়ান্ত শপথের মাধ্যমে একজন কর্মী ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বের গুনাবলী অর্জন করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, দেশ সাংবিধানিকভাবে ২ বার এবং রাজনৈতিকভাবে ৩ বার স্বাধীন হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ শুধু সকল রাজনৈতিক দল নয়, বরং নিজ দলকেও নিষিদ্ধ করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা দেশের পরিবর্তে দল ও গোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য রক্ষীবাহিনী গঠন করে ৩৪ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। তাদের দুর্নীতি-লুটপাট, অত্যাচারে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য জাতি দীর্ঘদিন তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। এক পর্যায়ে অতীতের ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে ১৯৯৬ সালে আ’লীগ আরেকবার ক্ষমতায় এসেছিল। তারা ক্ষমতায় গিয়েই দেশের লাশের স্তুপ ফেলেছিল। দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০১ সালে ৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় গিয়েছিল। তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন এই সরকারকে এক মিনিটও শান্তিতে থাকতে দিবেন না। তিনি তাই করেছিলেন। ফখর-মঈন সরকারের সাথে আতাত করে ক্ষমতায় গিয়ে শেখ হাসিনা গত দেড়যুগ মানুষের উপর সীমাহিন জুলুম নিপীড়ন চালিয়েছে। তারা জাতিকে- জনে জনে মামলা, ঘরে ঘরে হামলা- উপহার দিয়েছে। মানুষের ভোটে অধিকার, ভাতের অধিকার, কথা বলার অধিকার, বিচারের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। আওয়ামী ফ্যাসিস্টের জুলুম যখন সকল সীমা অতিক্রম করেছিল। তখনই আল্লাহর সাহায্য হিসেবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত হয়েছে। এথেকে ফ্যাসিস্ট সরকারদের জন্য রয়েছে ইতিহাসের শিক্ষা।
মাজেদ মাহফুজের পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সুচীত সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত ছিলেন- জামায়াতের সিলেট অঞ্চল টীম সদস্য হাফিজ আব্দুল হাই হারুন, ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা আলিম হোসেন খান, সিলেট মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুর রব, ড. নুরুল ইসলাম বাবুল ও জাহেদুর রহমান চৌধুরী, সাবেক ছাত্রশিবির নেতা সুলতান আহমদ ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সিলেট মহানগর সভাপতি শরীফ মাহমুদ প্রমূখ।
সম্মেলনে একক ইসলামী সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রাসেদুল হাসান রাসেল। সম্মিলিত কণ্ঠে ইসলামী সংগীত পরিবেশন করেন সিলেট সাংস্কৃতিক সংসদের শিল্পীবৃন্দ।