সিন্টু রঞ্জন চন্দ
তিন দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া সুনামগঞ্জ নদীতে বাঁধ ভেঙে এবং মৌলভীবাজারে নদ-নদীর বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে শতাধিক বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। তিন দফা বন্যার পর এখন চার দফা বন্যার কবলে মানুষ এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
সিলেট:
সিলেটে বুধবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। দুপুর ১২টার পর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরও কমে এসেছে। তবে বাড়ছে সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টের নদ-নদীর পানি। এর মধ্যে কুশিয়ারা নদীর দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর কাল শুক্রবার পর্যন্ত সিলেটসহ দেশের কয়েকটি অঞ্চলে হালকা থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপসহকারী আবহাওয়াবিদ অমর চন্দ্র তালুকদার বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ৩৬ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ২০৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে এসেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে অতি ভারী বৃষ্টিপাত ধরা হয়। আবার ২৪ ঘণ্টায় ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে ভারী বৃষ্টিপাত ধরা হয়।
বৃষ্টিপাত কমে এলেও সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্ট ও শেওলা পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। তবে অন্য কোনো নদ-নদীর পয়েন্টে বুধবার বেলা তিনটা পর্যন্ত বিপৎসীমা অতিক্রম না করলেও বিপৎসীমার কাছাকাছি রয়েছে। নদীর ওই পয়েন্টে বুধবার বেলা ৩টায় বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। নদীর ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৯ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার।
কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টে বেলা তিনটায় পানি বিপৎসীমার তিন সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ওই পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ৮ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া বিপৎসীমার কাছাকাছি রয়েছে কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ, সুরমা নদীর সিলেট ও কানাইঘাট পয়েন্ট।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সিলেটে বৃষ্টিপাত কমে এলেও বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। সিলেটের বৃষ্টিপাতের ওপর এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি নির্ভর করে না। মূলত ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় পাহাড়ি ঢলের ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, চলতি সময়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধোপাজান নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে নদীতীরের শতাধিক বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে প্রায় ১০০ পরিবার। নদীর গর্ভে বিলীন চার গ্রামের একমাত্র সড়কটিও। অব্যাহত নদী ভাঙনে দিশেহারা স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় লোকজন জানান, সীমান্ত নদী ধোপাজান হয়ে জেলার প্রধান নদী সুরমায় প্রতিদিন বাল্কহেড, টাঙ্গুয়ার হাওরের হাউসবোট, স্পিডবোটসহ শত শত নৌযান যাতায়াত করে। এ কারণে সবসময় নদীতে প্রচÐ ঢেউ থাকে। এছাড়া উজান থেকে নেমে আশা পাহাড়ি ঢলের কারণে এই সীমান্ত নদীতে প্রচÐ স্রোত থাকে, যা সরাসরি আঘাত হানছে নদীর পাড়ে।
সরেজমিনে সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সদরঘর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদী ভাঙনের ভয়ঙ্কর চিত্র। ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে বাড়িঘরের সব জিনিসপত্র।
ভাঙন রোধে দ্রæত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সুরমা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা বাসিন্দাদের। সংশ্লিষ্টদের কাছে বারবার জানালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বøক ফেলে ভিটেমাটি রক্ষার কথা বলে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা গ্রামবাসীর কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুনামগঞ্জে এ বছর তিন দফায় বন্যা দেখা দিয়েছিল। এই তিন দফা বন্যার কারণে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে আমরা প্রায় ১১টি স্থান চিহ্নিত করেছি। এসব স্থানে প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ভাঙন দেখা দিয়েছে। এই ভাঙনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের সাতশ মিটার। এই সাতশ মিটারে কাজ করার জন্য আমরা ৪৫ কোটি টাকার একটা চাহিদা দিয়েছি। যদি অর্থ বরাদ্দ পাই, তাহলে আমরা এখানে কাজ করব।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, এই ধরনের অভিযোগ আমরা পূর্বে পাইনি। এখন যেহেতু এ অভিযোগটি এসেছে, আমরা বিষয়টি দেখব।
হবিগঞ্জ: ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বেড়েই চলেছে হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি। নদীর পানি সবগুলো পয়েন্টেই বিপৎসীমার অতিক্রম করেছে। ফলে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুধবার দুপুর পর্যন্ত খোয়াই নদীর পানি চুনারুঘাটের বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯৯ সেন্টিমিটার ওপর, শায়েস্তাগঞ্জ পয়েন্টে ১২০ এবং শহরের মাছুলিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে, কুশিয়ারা নদীর পানি আজমিরীগঞ্জ ও মার্কুলি পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়াও টানা বৃষ্টি অব্যাহত থাকার কারণে হবিগঞ্জ শহরের অলিগলিতেও জলজটের সৃষ্টি হয়েছে। আর এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের।
হবিগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এবং উজানের পানি নেমে আসায় নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। বৃষ্টিপাত কমলেই পানিও কমে যাবে।
মৌলভীবাজার: তিন দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে মৌলভীবাজারে নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলার চার স্থানে মনু নদের তীররক্ষা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এছাড়া বৃষ্টির পানিতে সদর উপজেলার কুশিয়ারা তীরের বিভিন্ন গ্রামসহ কাউয়াদীঘি ও হাকালুকি হাওরপাড়ের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এতে জেলার অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বুধবার দুপুর ১২টার তথ্য অনুযায়ী মনু নদের রেলওয়ে ব্রিজে ১০৫ সেন্টিমিটার, চাঁদনীঘাটে ৭০ সেন্টিমিটার, ধলাই নদীর রেলওয়ে ব্রিজে ৮ সেন্টিমিটার, জুড়ী নদীর ভবানীপুরে ১৭৪ সেন্টিমিটার ও কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের হাজীপুর এলাকায় ২০ আগস্ট দিবাগত রাতে মনু নদের তীররক্ষা বাঁধের প্রায় ৪০০ ফুট ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে জেলা সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি বাড়তে থাকায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার জুনাব আলী জানান, হাজীপুর, গুদামঘাট, মিয়ারপাড়াসহ পাঁচ থেকে ছয়টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
মনু নদের তীররক্ষা বাঁধ ভেঙে রাজনগর উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের একামধু, মিয়ারপাড়া ও উজিরপুর এলাকায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এতে একামধু, উজিরপুর, কোনাপাড়া, কান্দিরকুল, আকুয়া, সৈয়দনগরসহ বিভিন্ন গ্রামের দেড় হাজারের বেশি পরিবার বানের পানিতে ভাসছেন বলে জানান স্থানীয় আব্দুল আজিজ নামক জনৈক ব্যক্তি। রাজনগরের কামারচাক ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, ধলাই নদীর পানি তীর মাড়িয়ে ও মনু নদের তীর ভেঙে লোকালয়ে ঢুকে কামারচাক ইউপির ৮০ ভাগ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল মনু নদের চার স্থানে তীররক্ষা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, উজানে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি হবে বলে আবহাওয়া বার্তায় জানা গেছে। এতে জেলার নদ-নদীগুলোতে আরও পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও জানান, মনু ও ধলাই নদীর বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন বালু-ভর্তি বস্তা ফেলে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন।