স্টাফ রিপোর্টার
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সিলেটে অনেকটা আতঙ্কের মধ্য দিয়ে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। সকালে নিরুত্তাপ ছিল ভোটের ময়দান। ভোটারদের আনাগোনা ছিল কম। প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরলেও ভোটার টানতে পারেননি।
তবে দুপুর থেকে কেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার করতে গেলে বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। কেন্দ্রের সামনে প্রকাশ্যে যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে রাম দা হাতে মহড়াও দেখা যায়। বিকেলে বৃষ্টিভেজা ভোটের মাঠ উত্তপ্ত করে তোলেন বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষের সমর্থকরা।
বুধবার সকাল ৮টা থেকে সিলেট জেলার চারটিসহ বিভাগের ১১টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। শুরুটা ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু বিকেল ৪টায় শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সেই শান্তি বজায় থাকেনি। সবদিকে কেবল চরম উত্তেজনার খবর ছড়িয়ে পড়ছিল। এর মধ্যেই বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়। শুরু হয় গণনার কার্যক্রম। বিভাগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত ১১টি উপজেলা হলো- সিলেট জেলার সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ ও গোলাপগঞ্জ, সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা, মৌলভীবাজারের জুড়ি, কুলাউড়া ও বড়লেখা এবং হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং।
সিলেটের সদর উপজেলায় দুটি কেন্দ্র দখলের চেষ্টা হয়। গোলাপগঞ্জ উপজেলার একটি কেন্দ্র দখলে গিয়ে রাম দা হাতে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করেন যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে একদল লোক। স্থানীয়রা জানান, গোলাপগঞ্জ উপজেলার কাইস্তগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা আড়াইটার দিকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বেলা আড়াইটার দিকে ওই বিদ্যালয় কেন্দ্রে উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী শাহিদুর রহমান চৌধুরী জাবেদ (ঘোড়া) ও আবু সুফিয়ান উজ্জ্বলের (আনারস) কর্মী-সমর্থকরা একসঙ্গে কেন্দ্রে ঢুকেন। কেন্দ্রের বাইরে স্থানীয় ইউপি সদস্যের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজনা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় অপর প্রার্থী মঞ্জুর কাদির শাফি চৌধুরী এলিমের (দোয়াত-কলম) কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও উত্তেজনা ছড়ায়।
এই ঘটনার জের ধরে আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আবু সুফিয়ান উজ্জলের পক্ষে জেলা যুবলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মনিরুল হক পিনু নেতৃত্বে কর্মীরা প্রকাশ্যে কেন্দ্রের সামনে এসে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করেন। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় আতঙ্কে ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে কেন্দ্রটি। উপস্থিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। খবর পেয়ে স্ট্রাইকিং ফোর্স ও মোবাইল টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছালে অস্ত্রধারীরা পালিয়ে যায়।
তবে এ ঘটনায় ভোটগ্রহণে কোনো প্রভাব পড়েনি দাবি করে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আব্দুস শহীদ বলেন, ঘটনার পরও কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলেছে। অবশ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিজিৎ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, বাইরে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। তবে ভোটে কোনো প্রভাব পড়েনি।
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে সিলেট সদর উপজেলার খাদিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দলবেঁধে নারীদের তিনটি বুথে ঢুকে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে চলে যান। খবর পেয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্ট্রাইকিং ফোর্স কেন্দ্রে অবস্থান করে। এসময় বিশৃঙ্খলার কারণে কোনো ভোটার উপস্থিত ছিলেন না।
এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন স্ট্রাইকিং ফোর্স ওই কেন্দ্র ত্যাগ করে। পরে আবারও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রে ঢুকে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেন। এক পুলিশ সদস্য বাধা দিতে গেলে বাকবিতÐায় লিপ্ত হন তারা। তারা পুলিশ সদস্যকে ধরে টানা-হেঁচড়াও শুরু করেন। এসময় উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে পুলিশের কঠোর অবস্থানে নেতা-কর্মীরা কেন্দ্র ত্যাগ করেন। ছাত্রলীগের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে কিছুক্ষণ আটকা পড়েন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ চৌধুরী। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে তিনি কেন্দ্র ত্যাগ করেন।
ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার দ্বিরাজ বর্মণ বলেন, দুপুরে ১২টার সময় একদল বহিরাগত যুবক ভেতরে ঢুকে জোরপূর্বক ভোট দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন ভোটদানে নিয়োজিত কর্মকর্তারা নিরাপত্তার কারণে ব্যালট নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে গিয়ে অবস্থান নেন। বেলা ১২টা ২০ মিনিটে আবারও ভোটগ্রহণ শুরু হলেও বহিরাগতদের ঝামেলার কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। তরে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ফের পৌনে ১টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়।
এছাড়া সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নের দলদলি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুপুরে একঘণ্টা ভোটগ্রহণ সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। ওই কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন চা শ্রমিকরা। এসময় জাল ভোটারের ছবি তুলতে গেলে রেজা রুবেল নামে এক ফটোসাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
এর আগে এক কেন্দ্রে প্রার্থীর এজেন্টকে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান পদে কাপ-পিরিচ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ সুজাত আলী রফিক। আর টেলিফোন প্রতীকের প্রার্থী মো. খলিলুর রহমান ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, সিলেট সদর উপজেলার কয়েকটি কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা হয়েছে। ভোটারদের উপস্থিতি কম থাকায় প্রার্থীর পক্ষের লোকজন ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া দুপুরে নগর সংলগ্ন দলদলি চা বাগান বিদ্যালয় কেন্দ্র দখলের চেষ্টায় কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণ স্থগিত ছিল। পরে আবার ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। তবে বিশৃঙ্খলার দায়ে কাউকে আটক করা হয়নি। কেবল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলা বেশ কিছু মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে।
সিলেটের চার উপজেলার ৩০২টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১৭৪টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ ধরে নিরাপত্তা পরিকল্পনা করে সিলেট জেলা ও মহানগর পুলিশ। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ছয় হাজারের বেশি পুলিশ ও আসনার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
সিলেট বিভাগের চারটি উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা আট লাখ ১৪ হাজার ৫২ এবং ভোটকেন্দ্র ৩০২টি। এর মধ্যে ২২টিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর মাধ্যমে এবং বাকিগুলোতে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।