কাজির বাজার ডেস্ক’
নিমতলি থেকে চুড়িহাট্টা, বঙ্গবাজার থেকে বনানী, রাজধানী ঢাকায় যতোগুলো বড় আগুন আর হতাহতের ঘটনা, সবকিছুর সাক্ষী এই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট। আবারও যেন সেই বিভীষিকাময় রাত ফিরে এলো ঢামেক হাসপাতালে। অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। আছে লাশের স্ত‚প, দগ্ধ ও আহত রোগীদের চাপ। মৃত্যুর মিছিলে যেন পরিণত গোটা জনপদ। শুক্রবার রাত ১টা ২৪ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণে আসে বিরাট এক কাভার্ডভ্যান। ফায়ার সার্ভিসের এই রেফ্রিজারেটর স্টোরেজ ট্রাকটি দেখে স্বজনদের আর বুঝতে বাকি থাকে না এর ভেতরে রয়েছে কেবলই লাশ। ট্রাক থেকে নামানো হয় একে একে দশটি মরদেহ। শুরু হয় উচ্চশব্দে কান্না। ট্রাকের ভেতরের মানুষরা যাদের কাছের মানুষ নন, তাদেরকেও চোখ মুছতে দেখা গেল।
বেইলি রোড ট্র্যাজেডিতে নিহত ৪৪ জনের মধ্যে ১০ জনের মরদেহ রাখা হয়েছে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে। এছাড়া, ৩৩টি মরদেহ রয়েছে ঢাকা মেডিকেল মর্গে। একটি মরদেহ রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে (সিপিএইচ) রয়েছে। প্রিয়জনের খোঁজে স্বজনদের ভিড়। কেউ ছেলে হারিয়েছেন, কেউ বোন, আবার কেউ হারিয়েছেন সহপাঠী। ঢাকা মেডিকেল আর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সেখানে থাকা নিহতের একজন স্বজন বলেন, বাচ্চাকে বাঁচিয়ে মা মারা গেছে। সবাইকে বাঁচিয়ে সে মারা গেছে। আমার ভাইয়ের স্ত্রী, দুই বাচ্চা, সবাইকে সে বাঁচিয়েছে। আরেক স্বজন বলেন, মরদেহ অনেক। এক জায়গা থেকে খোঁজ নিতে আরেক জায়গায় যাচ্ছি। এতো মরদেহ যে, স্থান সংকুলান হয় না।
এর মাঝেই কেউ খুঁজে ফিরছেন প্রিয়জনকে। কাছের মানুষ জীবিত আছেন না মৃত, সেই শঙ্কাতেই হাসপাতালজুড়ে ছুটোছুটি। রাতভর স্বজনহারাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে ঢাকা মেডিকেল ও বার্ন ইনস্টিটিউট। চোখে অশ্রæ নিয়ে নিহতের এক স্বজন জানান, আমার পরিবারের ৩ জন ছিল, সবাই মারা গেছে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে..। আগুনের ঘটনায় নারী ভুক্তভোগীর বেশিরভাগ মারা গেছে বলে দাবি আরেক স্বজনের।
রাজধানীর বেইলি রোডে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের বহুতল ভবনে লাগা আগুনে এখন পর্যন্ত ৪৪ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সারি সারি পড়ে আছে এ ঘটনায় দগ্ধ লাশ। আপনজনদের মরদেহ নিতে আসরা স্বজনদের আহাজারিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা যেন ভারী হয়ে উঠেছে।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে অগ্নিকাÐের এ ঘটনা ঘটে।
বহুতল ভবনের একটি ফ্লোরে থাকা কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন মুহ‚র্তেই ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেখানে। রেস্টুরেন্টে আসা শতাধিক মানুষ আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারে সেখানে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভবনে আটকে পড়ে যায় খেতে আসা মানুষরা।
আগুনের সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস। ১৩টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। তবে উৎসুক জনতার ভিড়ে ফায়ার সার্ভিসকে কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছে। এতে নারীসহ অন্তত ৪৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই ভবন থেকে ৭০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে পুলিশ, র্যাব। মোতায়েন করা হয়েছে ৩ প্লাটুন বিজিবি ও আনসার।
ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার এরশাদ হোসেন জানান, বেইলি রোডের কেএফসি ভবনের পাশে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের ভবনে আগুন লাগার খবর আসে রাত ৯টা ৫০ মিনিটে। খবর পেয়ে প্রথমে চার ইউনিট, পরে আরও চারটি ইউনিট পাঠানো হয়। এরপর আরও চারটি ইউনিট কাজ শুরু করে।
রাত পৌনে ১২টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর মধ্যেই একের পর এক আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে থাকে ফায়ার সার্ভিস। বিভিন্ন ফ্লোরে খাবার খেতে আসা মানুষদের অনেকেই ছাদে গিয়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
ফায়ার সার্ভিস মই দিয়ে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করে। ভেতরে আটকে থাকা অনেকেই ধোঁয়ার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। রাত ১২টা পর্যন্ত ওই ভবন থেকে ৭০ জনকে জীবিত উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
এদিকে, আগুনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ভবনটির সামনে ভিড় করতে শুরু করেন ভেতরে আটকে পড়াদের স্বজনরা। অনেকেই স্বজনদের খোঁজ না পেয়ে কান্না করতে থাকেন। হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে সেখানে। অনেককেই দেখা যায় নিখোঁজ স্বজনদের ছবি নিয়ে ছোটাছুটি করছেন।