কাজির বাজার ডেস্ক
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বর্তমান সরকার তাদের যাত্রা শুরু করেছে। আর এই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্মার্ট এডুকেশন। সেই লক্ষ্যে বেশ আগে থেকেই কাজ শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে গত বছর থেকে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম।
একই সঙ্গে শিক্ষার অবকাঠামোতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ৬৫ হাজার ২৪২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের ১৬টি প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাব অনুমোদিত হলে বর্তমান সরকারের মেয়াদেই শিক্ষার অবকাঠামোতে বিপ্লব আসবে, যা স্মার্ট এডুকেশন বাস্তবায়নের অংশ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা যায়, গত সরকারের মেয়াদে ছয় শতাধিক স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ হয়।
সেসব প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো খুব একটা ভালো নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে ভবনও নেই। নতুন প্রকল্পে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রায় ৩০ হাজার এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিন হাজার প্রতিষ্ঠানে এখনো কোনো ভবনই নির্মাণ করা হয়নি।
সেখানে রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াই কষ্টকর হয়ে পড়ে। নতুন প্রকল্পের আওতায় সেসব প্রতিষ্ঠানেও ভবন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া নতুন প্রকল্পে কলেজ, হাওর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের স্কুল-কলেজকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র বা অন্যান্য ধরনের বৈষম্য দূর হবে। আর এই শিখনকালীন মূল্যায়নে শ্রেণিকক্ষেই বেশির ভাগ পড়ালেখা শেষ করতে হবে শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া নানা ধরনের দলগত কাজ করতে হয় নতুন শিক্ষাক্রমে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনীয় ক্লাসরুম না থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে পড়বে। এ জন্য শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতো গ্রামের স্কুল-কলেজেরও অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি।
জানতে চাইলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘স্মার্ট দেশের জন্য স্মার্ট এডুকেশনের প্রয়োজন। আর স্মার্ট শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে, যাতে তারা আকর্ষণ বোধ করে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে গ্রাম-শহরের বৈষম্য শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। নারীশিক্ষার প্রসার হবে। আমরা নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে মিল রেখে শিখন পদ্ধতির রূপান্তরে অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছি। যেসব প্রতিষ্ঠানে এখনো সরকারি ভবন করা হয়নি বা যেখানে শিক্ষার্থীর তুলনায় অবকাঠামোর সংকট আছে, সেখানে আমরা উন্নয়ন করতে চাই। এ জন্য আমাদের অধিদপ্তর থেকে স্টাডি শেষে নতুন ১৬টি প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার অবকাঠামোতে বিপ্লব সাধিত হবে।’
প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার আরো বলেন, ‘শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার খুবই আন্তরিক। তবে করোনা মহামারিসহ নানা কারণে যেসব প্রকল্প বন্ধ ছিল, সেগুলো আমরা গত বছর চালু করতে সক্ষম হয়েছি। ঠিকাদারদের ২০২২ সালের নতুন রেট দেওয়া হয়েছে, যাতে নির্মাণসামগ্রীর ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে অবকাঠামোতে মানের কোনো ঘাটতি না হয়। এ ছাড়া বৃহত্তর পরিবেশে কাজ করতে আমাদের অধিদপ্তরের জন্য নতুন অর্গানোগ্রামের প্রস্তাব করা হয়েছে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ‘সরকারি অর্থায়নে অদ্যাবধি ভবন নির্মিত হয়নি, এরূপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন হাজার ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। ‘নির্বাচিত বেসরকারি কলেজগুলোর ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে এক হাজার কলেজে ভবন নির্মাণ করা হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পে যেসব বেসরকারি কলেজে অধ্যাবধি ভবন নির্মিত হয়নি এবং যেসব কলেজের নির্মিত ভবনের ঊর্ধ্বমুখী ও আনুভ‚মিক সম্প্রসারণ প্রয়োজন সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
‘নতুনভাবে জাতীয়করণকৃত কলেজসমূহের অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পে ৩৩৫টি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন করা হবে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ‘নির্বাচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের বিদ্যমান ভবনের সম্প্রসারণ’ প্রকল্পে তিন হাজার ৬০০ ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হবে। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার কোটি টাকা। ‘হাওর এলাকার নির্বাচিত অবশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন হবে। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। ‘কালেক্টরেট স্কুল ও কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পে ৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন পাবে। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় এক হাজার ৯২০ কোটি টাকা।
‘নির্বাচিত কলেজসমূহে মাল্টিপারসার ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৭০ কোটি টাকা। ‘নির্বাচিত কলেজসমূহে অডিটরিয়াম ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পের ব্যয় ১৯২ কোটি টাকা। ‘নির্বাচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে হোস্টেল ও ডরমিটরি নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ২৫৬ কোটি টাকা। ঢাকা কলেজে ৫০০ শয্যার ছাত্রাবাস নির্মাণ’ প্রকল্পের ব্যয় ৪৮ কোটি টাকা। ‘বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজে ৪৫০ শয্যার শেখ ফজিলাতুন নেছা ছাত্রী নিবাস নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৭ কোটি টাকা। ‘খুলনা পাবলিক কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা। ‘মিলিটারি কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের ব্যয় ৪৫ কোটি টাকা। ‘রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের নির্বাচিত ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া ‘নতুনভাবে সৃজনকৃত ৪৮৯টি উপসহকারী প্রকৌশলী, ২৭টি নির্বাহী প্রকৌশলী ও চারটি তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী অফিস ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৪৩ কোটি টাকা।
সম্প্রতি অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্পের অনুমোদন ও বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে ‘নোয়াখালী সরকারি কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্প। যার ব্যয় ৪৯.৯৮ কোটি টাকা। ‘কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ ও লাকসাম উপজেলার নির্বাচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন’ প্রকল্পের ব্যয় ৪৯ কোটি টাকা। ‘চাঁদপুর জেলার গনি মডেল এবং লুধুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের ব্যয় ৪৮ কোটি টাকা। ‘ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ১০ তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পের ব্যয় ৪৮ কোটি টাকা। ‘বালাগঞ্জ মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পটি ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিদেশি অর্থায়নে বা সাহায্য নিয়ে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে ‘হাওর এলাকায় নির্বাচিত উপজেলা সদরে ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’। সৌদির অর্থায়নে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ২৯ কোটি টাকা। ‘রাজশাহী কলেজ মাঠ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ক্রীড়া সুবিধা স্থাপন’ প্রকল্পের ব্যয় ৯.৭৬ কোটি টাকা। ‘ওড়াকান্দি দেবী শাস্ত্রি সত্যভামা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জকে যথাযথ মানে উন্নীতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের ব্যয় ২৭.৬৮ কোটি টাকা।
জানা যায়, গত ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে নির্মিত এক হাজার ২৫৯টি নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। একই দিনে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী সারা দেশে নির্মিত ৪৭০টি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকাজের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে অধিদপ্তরের অধীনে ৩৬টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের জন্য সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১৫টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত এক হাজার ৭৪৯ কোটি টাকার মধ্যে এক হাজার ৭৪০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। যার অগ্রগতি ৯৯.৪৮ শতাংশ।
সূত্র জানায়, স্মার্ট এডুকেশনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে প্রস্তুত হতে এরই মধ্যে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। গত বছর এই অধিদপ্তরের শূন্য পদ পূরণে ২৫৪ জন কর্মকর্তাসহ ৯৯১ জনবল নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। ১১ থেকে ১৬তম গ্রেডের ৫১৩টি পদ পূরণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী পদে ছয়জন, নির্বাহী প্রকৌশলী পদে ছয়জনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৩১ জন কর্মকর্তা ও ২৮ জন কর্মচারীকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) প্রণয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা আগে ছিল না। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে অবকাঠামোর ডিজাইন বা ড্রইং যথাসময়ে সরবরাহের লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র ডিজাইন শাখা করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা হচ্ছে।