বেকারত্বের ঘানি কঠিন থেকেও কঠিনতর হচ্ছে

9

 

শিক্ষায় সমাজ প্রগতিশীল হয়। আর সেই সমাজে বাড়তে থাকা শিক্ষিত বেকার বেশ দুঃখজনক। শিক্ষার গতানুগতিকতায় শিক্ষার্থীরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেও থাকছে বেকার। অসহনীয় বোঝায় ভারী হয়ে উঠছে বেকারত্বের ঘানি। পড়াশোনা শেষ করে সঠিক যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন কতজন তাও প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষিত বেকার বাড়ার পেছনে কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো চাকরির বাজারে যেরকম জনবলের চাহিদা প্রয়োজন; সে তুলনায় তৈরি না হওয়া। প্রতি বছর যেসব শিক্ষিত লোক চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন, তাদের উপযোগী চাকরি নেই। গত ১০ বছরে দেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কারণ, দেশে প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। আবার কারিগরি ক্ষেত্রে দক্ষ লোকের অভাবেও স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করা শিক্ষার্থীরাও যথেষ্ট সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ, দেশে বর্তমান সময়ে চাকরির সুযোগ বাড়ছে উৎপাদনশীল ও কৃষি খাতে। যেখানে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করা শিক্ষার্থীদের সুযোগ কম। এছাড়াও যেসব তরুণ-তরুণীরা ছোটখাটো ব্যবসায় সংযুক্ত হয়ে আত্মকর্মসংস্থানে নিযুক্ত হয়েছিলেন তার বেশ বড় অংশই ঝরে পড়তে দেখা গেছে করোনার সময়ে। সামাজিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, তরুণ প্রজন্মের ভালো একটা অংশ বেসরকারি খাতে চাকরির লাভের আশা করছে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ব্যবস্থা বাড়ায় বেসরকারি খাতে চাকরি নিয়ে ক্যারিয়ার গঠনে পিছপা হচ্ছে তরুণরা। কারণ, সরকারি চাকরি লাভে বেসরকারি খাত সেই তুলনায় বেশ পিছিয়ে আছে। যার ফলে সরকারি চাকরির ন্যায় সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে থাকা তরুণ প্রজন্মকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। পরীক্ষার প্রস্তুতি কিংবা পরীক্ষার আয়োজনে দেরি হওয়ায় দীর্ঘ সময় তারা বেকার থাকছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। এছাড়াও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ। এই বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার পুরুষ আর আট লাখ ৩০ হাজার নারী।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবার যেন শিক্ষিত বেকারদের জীবন আরও কঠিন করে তুলছে। সরকারি চাকরির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে এখন থেকে চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনের ফি’র ওপর কমিশন ও মূল্য সংযোজন কর দিতে হবে। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, টেলিটকের মাধ্যমে আবেদন ফি ২০০ টাকা প্রদেয় হলে, চাকরিপ্রার্থীকে ১০ শতাংশ কমিশন হিসাবে অতিরিক্ত ২০ টাকা এবং কমিশনের ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসাবে আরও ৩ টাকা দিতে হবে। যেখানে বেকারদের নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। চাকরির আবেদন ফি এ ভ্যাট নির্ধারণ করার বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘চাকরিতে আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর চাপাচাপি করে ভ্যাট বসানো ঠিক হচ্ছে না। আমরা উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের বিনা পয়সায় চাকরিতে আবেদনের সুযোগ দিতে পারলে, সেটা ভালো হতো। কিন্তু সেটা করা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে একান্ত ন্যূনতম ফি নিয়ে শিক্ষার্থীদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া উচিত।’ চাকরি পাওয়া যখন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে তখন এই সোনার হরিণের পিছু ছোটা চাকরিপ্রার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে বিপুল প্রতিযোগিতায়। প্রতিযোগিতার পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দামে পালস্না দিয়ে বাড়ছে শিক্ষা উপকরণের দাম। এক রিম কাগজ কিনতে খরচ হতো ৪০০-৪৫০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬শ’ টাকার বেশি। যে কারণে সহায়ক বইগুলোর মূল্য প্রায় ৫০% বৃদ্ধি। প্রতি পিস কলমের দাম ৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডজনপ্রতি বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। সাধারণ ক্যালকুলেটর ৮০ থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জ্যামিতি বক্স ১০০ থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাগজের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে ফটোকপির দোকানেও। আগে যেখানে প্রতি পেজ ফটোকপি ১ থেকে দেড় টাকা রাখা হতো এখন সেখানে ২ থেকে ৩ টাকা রাখা হয়। নাভিশ্বাস ওঠা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেড়েছে যানবাহনের ভাড়া। যে কারণে আর্থিক অবস্থার দুর্গতিতে চাকরি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিমুখ হয়েছেন অনেকেই। আবার যারা চাকরির লক্ষ্যে গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়েছেন তাদের অনেকেই মেস ভাড়া বাড়ায় অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন অনেকেই আর্থিক অবস্থার অসংকুলান এবং পারিবারিক অসহযোগিতার কারণে। সম্প্রতি খুলনায় চাকরি পরীক্ষা দিতে গিয়ে পরীক্ষা হলের ছাদ থেকেই লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন এক চাকরিপ্রার্থী।