দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সের সংকট নিয়ে অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মেডিকেল যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের মতো দক্ষ জনবলেরও সংকট রয়েছে। বেশির ভাগ সময়ই নষ্ট থাকছে বিপুল অর্থ ব্যয়ে কেনা যন্ত্রপাতিগুলো। ওষুধ সরবরাহের ঘাটতি ও স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টদের পেশাদারত্বের অভাবের অভিযোগও রয়েছে অনেক। জটিল রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিজ জেলা-উপজেলায় চাহিদামাফিক সেবা না পেয়ে রোগীদের বড় একটি অংশ হয়ে পড়ছে ঢাকামুখী।
শুধু জটিল নয়, মৌলিক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ঘাটতিতে ভুগছে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ‘ডাটা কালেকশন সার্ভে অন হেলথ সেক্টর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে মৌলিক ছয়টি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যন্ত্র আছে প্রয়োজনের তুলনায় ৬১ শতাংশের কিছু কম। সে অনুযায়ী এসব হাসপাতালে এসব যন্ত্রের অপ্রতুলতার হার ৩৯ শতাংশের বেশি। আবার যেসব জায়গায় যন্ত্রপাতি রয়েছে, সেখানেও বড় একটি অংশ অকেজো ও নষ্ট। এসব যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, করোনারি কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) মনিটর, মাইক্রোস্কোপ ইত্যাদি। জেলা হাসপাতালগুলোয় নষ্ট যন্ত্রপাতির ৯৩ শতাংশ অকেজো পড়ে রয়েছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। উপজেলা পর্যায়ের ক্ষেত্রে এ হার ৯৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে নগর ও গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যায় অপ্রতুলতার চিত্রও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দেশের শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজার মানুষের বিপরীতে চিকিৎসক ও নার্স রয়েছেন ১৮ দশমিক ২ জন। গ্রামাঞ্চলে এই হার ১ দশমিক ১ জন।
হাসপাতালে সেবাদানের সক্ষমতায় ঘাটতির কথা স্বীকার করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও। দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জনবলের ঘাটতি এখানে সক্ষমতার দ্বিগুণ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে উঠেছে। ১৯৯৭ সালে ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হওয়া সরকারের মাধ্যমিক পর্যায়ের এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কাঠামো অনুযায়ী লোকবল নেই। অর্ধেকের বেশি চিকিৎসকের পদ খালি। অনুমোদিত পদের বিপরীতে নার্স নেই ৩০ শতাংশ।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে শুধু ব্যবস্থাপনার অভাবেই প্রত্যাশিত সেবার ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডবিøউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য নীতি বদলিয়ে জনস্বাস্থ্য নীতি করা দরকার, যেটা জনবান্ধব হবে। দেশে মানুষ সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছে না। ফলে বিরাটসংখ্যক মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। ধনী লোকের পাশাপাশি দরিদ্র মানুষও বিদেশে যাচ্ছে। তারা সেবায় সন্তুষ্ট না। তাদের মানসম্মত সেবা দিতে গেলে বাজেটের সদ্ব্যবহার করা দরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, অপচয় ও দুর্নীতির কারণে বাজেট ঠিকমতো ব্যবহার না হয়ে ফেরত চলে যায়। উপজেলা থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায় পর্যন্ত মানুষ সঠিক সেবা পায় না। এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র শক্তিশালী করা জরুরি। সঠিক জনবল ও ল্যাব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর পরের ধাপে রোগীকে জেলা হাসপাতালে রেফার্ড করা হবে। রেফারেল ব্যবস্থাপনা না থাকায় রোগীরা কোথায় সঠিক সেবা পাবেন তা বুঝতে পারে না। জেলায় কাজ না হলে পরে ওপরের পর্যায়ে সেবা নেবে। দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান ভালো নয় এর বড় প্রমাণ বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া। বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায় বিদেশে সেবা নিতে গিয়ে। তাই সেবা ও প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন করতে হবে। দেশে প্রশিক্ষণ এখন সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এখানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।’
জেলা-উপজেলাসহ নানা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে বছর বছর বরাদ্দ বাড়িয়েছে সরকার। পরিকল্পনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে শুধু স্বাস্থ্যসেবা বিভাগেই উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এক দশকের ব্যবধানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা পাঁচ গুণ বেড়ে ১৫ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া খাতটির উন্নয়নে সরকার বিনিয়োগ করেছে ৮২ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা।
অন্যদিকে সরকারের বাজেট প্রক্ষেপণেও স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৯ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা, যা আগামী অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৩২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকায়। একই সঙ্গে জেলা-উপজেলা এবং জেনারেল হাসপাতালে বরাদ্দও বাড়বে। এ দুই পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবায় গত অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়াবে ৪ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। একইভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য অফিস, সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং নার্সিং ইউনিটের বরাদ্দও বছর বছর বাড়বে।
এর পরও সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে মানুষের। এতে বাড়ছে চিকিৎসা খাতে জনগণের অতিরিক্ত ব্যয় (আউট অব পকেট পেমেন্ট)। শুধু ব্যবস্থাপনাগত সংকটের কারণেই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মানুষকে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা।
কাক্সিক্ষত সেবা না পেয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় সেবাগ্রহীতার হার দিনে দিনে কমে আসছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২-এ উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৬ সালে সারা দেশের চিকিৎসা সেবাপ্রার্থীদের মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবাগ্রহীতার হার ছিল ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশে। আর জেলা বা সদর হাসপাতালে ২০১৬ সালে সেবাগ্রহীতার হার ছিল ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৯৯ শতাংশে। যদিও এ সময় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা নেয়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০২২-এ তা ১৩ দশমিক ১২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে শুধু অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও দক্ষ জনবল এবং জনবান্ধব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়নি বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা ও মান বৃদ্ধির জন্য বেশকিছু বিষয়ের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এর মধ্যে অবকাঠামো একটি অংশ মাত্র। এর সঙ্গে পর্যাপ্ত ওষুধ বা রসদ দরকার হয়। দক্ষ জনবল, নার্স-ডাক্তার লাগে। সর্বোপরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য একটি সুসমন্বিত ব্যবস্থাপনা দরকার হয়। এখানে বিনিয়োগ করে প্রচুর অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু রসদ, সুষ্ঠু সেবার জন্য জনবল গড়ে ওঠেনি। অদক্ষ এবং অপূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা চালু রয়েছে। তাই মানুষ আসছে না। সেজন্যই সেবার জন্য মানুষ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যায়।’