মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। মাদকদ্রব্য কেনাবেচা ও সেবন রোধে প্রণীত ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮’-তে মাদকাসক্ত শনাক্তে পরীক্ষা (ডোপ টেস্ট) করার বিধান রাখা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদকাসক্ত ব্যক্তি শনাক্ত করতে মাদকাসক্তি পরীক্ষা বা ডোপ টেস্ট করতে একটি বিধিমালা প্রণয়নের কথা। ২০১৮ সালে আইন পাস হলেও গত পাঁচ বছরে বিধিমালাটি চ‚ড়ান্ত করা হয়নি। ফলে সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করা হলেও সরকারি-বেসরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যে মাদকাসক্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ একটি ডোপ টেস্ট প্রকল্প করতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিধিমালা চ‚ড়ান্ত করার কাজ পিছিয়ে গেছে।
২০১৯ সালে জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৭ সালে বিশ্বে পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ মাদক। এর চেয়ে অনেক বেশি মাদকাসক্ত নানা ধরনের অসুস্থতা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মাদকপাচারের প্রধান দুটি আন্তর্জাতিক রুটের একটি রয়েছে বাংলাদেশে। ফলে বাংলাদেশেও মাদকের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে।
বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। কিশোর-তরুণদের কাছে মাদক সহজলভ্য হয়ে উঠছে। একটি বড় জনশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাদকের কারণে। সব ধরনের সরকারি চাকরিতে মাদকাসক্ত শনাক্তে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছে।
২০২০ সালে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাড়িচালকদের জন্য মাদক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছিলেন। এর আগে ২০১৮ সালে সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিসিএস ক্যাডার, নন-ক্যাডার সরকারি যেকোনো চাকরিতে যোগদানের আগে অবশ্যই ডোপ টেস্ট করতে হবে। গাড়ির কয়েক লাখ চালক ও সরকারি চাকরিপ্রার্থীর ডোপ টেস্ট দরকার।
পেশাদার গাড়িচালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। নির্ভরযোগ্য তথ্য বা গবেষণা না থাকলেও জনমনে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত যে গাড়িচালকদের একটি অংশ মদ বা অন্য কোনো মাদক খেয়ে গাড়ি চালায়। অনেক চালক গাড়ি চালানোর সময় বেসামাল থাকেন। ডোপ টেস্টের আওতায় আনলে চালকরা মাদক কম নেবেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। সরকারি চাকরিজীবীদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেনÑএমন খবর গণমাধ্যমেও এসেছে।
সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সব মাদকদ্রব্য। শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও তরুণসমাজে মাদকাসক্তি ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মাদক সিন্ডিকেট। যেকোনো মাদক ব্যবসায়ীর প্রধান লক্ষ্য উঠতি বয়সী কিশোর ও তরুণরা। অন্যদিকে মাদকাসক্তরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। সমাজের বিত্তবান ও ভদ্রঘরের সন্তানদের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানরাও সর্বনাশা এ নেশার জগৎ ঘিরে গড়ে তোলে বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট।
মাদকের অপব্যবহার শুধু মাদকেই সীমিত থাকে না, আরো বহু অপরাধের কারণ হয়। অন্যদিকে মাদকসেবীরা যেমন পরিবারের জন্য, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে চলতে থাকলে সমাজ ক্রমেই পঙ্গু হয়ে যাবে, সব উন্নয়নপ্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে। ‘ডোপ টেস্ট বিধিমালা’ চ‚ড়ান্ত হলে সব সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা যাবে। শিক্ষার্থীদের মাদক থেকে রক্ষা এবং সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে ডোপ টেস্ট করায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। কাজেই বিধিমালা প্রণয়নের কাজটি দ্রæত সম্পন্ন করতে হবে।