বাড়ছে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে অপরাধ যা ৩৫ শতাংশই আর্থিক প্রতারণার

20

কাজির বাজার ডেস্ক
ইমো সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে ‘রাজন স্টোরি’, ‘রাজন সলিউশন’সহ বিভিন্ন নামে ইমোতে অনেকগুলো গ্রæপ খোলেন মো. রাজন আলী। এসব গ্রæপে যুক্ত হওয়ার পর সদস্যদের টার্গেট করে বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন নম্বর থেকে ইমোতে অসংখ্য স্টিকার মেসেজ পাঠাতে থাকেন। এতে এক পর্যায়ে অ্যাকাউন্ট হ্যাং হয়ে যায়। তখন ওই ব্যক্তি গ্রæপে সহযোগিতা চাইলে রাজন ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। সমস্যা সমাধানে তার আইডিতে ঢোকার অনুমতি চান। এক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছে একটি ওটিপি যায়, ওই ওটিপির মাধ্যমে প্রবেশাধিকার পান রাজন। পরে ইমোতে প্রবেশ করে রাজন সব মেসেজ পড়েন এবং ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে তথ্য নেন। এরপর সেই আত্মীয়ের কাছে ‘আমি বিপদে পড়েছি, টাকা পাঠান’, ‘মা অসুস্থ, টাকা পাঠান’ এ সংক্রান্ত মেসেজ পাঠিয়ে বিভিন্ন অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তার, গত মে মাসে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। দেশে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে ডিজিটাল লেনদেন। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন বেড়েছে। একই সঙ্গে বাড়ছে এসব মাধ্যম ব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণা। প্রতিনিয়ত কৌশল পাল্টে মানুষকে ফাঁদে ফেলে প্রতারকরা লুটে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ২০২১ সাল থেকে এমন সব সাইবার অপরাধে এখন পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে তার ৩৫ শতাংশই আর্থিক প্রতারণার।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে আসা ৫৯৯টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১০টি মামলা হয়েছে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণার, যা সাইবার অপরাধের মোট মামলার ৩৫ শতাংশ। এসব মামলা আবার প্রতিবছরই বাড়ছে। অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণার ফলে ২০২১ সালে মামলা হয়েছে ৮৭টি, ২০২২ সালে ১০৯টি। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ১৪টি। বাকি মামলার মধ্যে রয়েছে পর্নোগ্রাফি ধারণ ও অনলাইন হ্যারাজমেন্ট, ফেসবুক হ্যাকিং বা অন্য হ্যাকিং, মানহানিকর বক্তব্য বা মিথ্যা তথ্যপ্রচার প্রভৃতি।
এ বিষয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের (উত্তর বিভাগ) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ফজলুর রহমান বলেন, বিকাশ, রকেট, কার্ড এসব মাধ্যম ব্যক্তিগত হওয়ায় নজরদারির সুযোগ খুবই কম। ফলে এই মাধ্যমগুলোতে আর্থিক প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। অনেকে বিশ্বাস করে কিংবা না বুঝেই কেউ ওটিপি দিয়ে দেওয়ায় আর্থিক প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
ডলার সংকটের কথা বলে বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীদের পণ্য কেনার জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এলসি-টিটির টাকা পাঠানোর নামে ভুয়া ব্যাংক সিøপ প্রদর্শন ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের নামে প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া বিল তৈরি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে প্রতারণা চালিয়ে আসছিল একটি চক্র। চক্রের চার সদস্যকে গত ৩০ মে রাজধানীর মহাখালী এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।
এছাড়া গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে ব্যাংক ও মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবায় প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। কৌশলে ব্যাংক ও মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে পাঠানো ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) জেনে টাকা তুলে নেয়। গত ২৬ মে বিকাশ, রকেট ও নগদের মাধ্যমে প্রতারণা করে বিভিন্ন কৌশলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া সুখি আক্তার নামে এক নারীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনলাইনে এমন নানা ধরনের প্রতারণার ঘটনায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে প্রতি মাসে ২০টিরও বেশি অভিযোগ ও মামলা হচ্ছে। এসব মামলার বেশিরভাগই অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণার।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের (দক্ষিণ বিভাগ) উপ-কমিশনার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে সাইবার জগতে প্রতারণার নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে। প্রতারকরা নানা কৌশলে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে আর্থিক প্রতারণা করছে। কেউ বুঝে বা না বুঝে তাদের ফাঁদে পড়ে খোয়াচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
সাইবার অপরাধ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, দেশে সাইবার অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। সাইবার জগতে নতুন নতুন অপরাধ ঘটছে। এর মধ্যে অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়ে টাকা খোয়াচ্ছেন। অনেকে সামাজিক হেনস্তার ভয় কিংবা নতুন করে কোনো ঝামেলায় না জড়াতে অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছেও যান না। এতে সাইবার অপরাধীরা এসব অপরাধ থেকে সরে না এসে অপরাধের সুযোগ পায়। তাই সাইবার সচেতনতার পাশাপাশি প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের আইনের সহযোগিতা নেওয়া খুব জরুরি।