মো. শাহজাহান মিয়া, জগন্নাথপুর থেকে
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে এবার বোরো ধানের হেট্রিক অর্জন হয়েছে। প্রথম ধাপে বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে গত প্রায় এক মাস আগে। এখন চলছে ডেমি ধান কাটার ধুম। এতে লাভবান হচ্ছেন প্রান্তিক গরীব পরিবারের মানুষজন। জমিতে রোপনকৃত মূল ধান কাটার পর কৃষকরা আর জমির খবর রাখেন না। তাদের কাটা ধানের ডগা থেকে দ্বিতীয় ধাপে ডেমি ধান হয়েছে। এসব ডেমি ধান দরিদ্র পরিবারের মানুষজন কেটে নিচ্ছেন।
জানাগেছে, জগন্নাথপুর উপজেলার সবচেয়ে বড় নলুয়ার হাওর সহ সকল হাওর ও বাওরে এবার ২০ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান উৎপাদিত হয়। গেল চৈত্র মাসের ১৫ তারিখ থেকে ধান কাটা শুরু হয়ে বৈশাখ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে শেষ হয়েছে। প্রকৃতি অনুকুলে থাকায় এবার বাম্পার ফলন হয়। যা সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ধান পান কৃষকরা। সেই সাথে তারা ধানের ভালো দাম পেয়ে এবার অনেক খুশি হন।
এদিকে-মূল ধান কাটা শেষ হওয়ার পর কাটা ধানের ডগা থেকে আবার ডেমি ধানের থোড় বের হয়। মাত্র ১৫/২০ দিনের মাথায় এসব ডেমি ধান পাকতে শুরু করে। যদিও ধান কাটার পর হাওরে অবাদে গবাদিপশু ছেড়ে দেন রাখালরা। এর মধ্যে হাওরের দুর এলাকায় যেখানে গবাদিপশু যেতে পারেনি সেখানেই ডেমি ধান পাওয়া যাচ্ছে। এবার এখনো হাওর ও খাল-বিলে পানি না থাকায় ডেমি ধান হয়েছে। তবে টানা বৃষ্টিপাতে হাওরে প্রায় হাঁটু থেকে উরু পানি জমে গেছে। এসব পানিতে নৌকা দিয়ে স্থানীয় হাওর পারের বিভিন্ন গ্রামের হতদরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ জনতা রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলক ডেমি ধান কাটছেন। কোন প্রকার খরচ ছাড়াই অন্যের জমিতে উৎপাদিত ডেমি ধান যে যেভাবে পারছেন, কেটে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। এতে বৈশাখে যাদের জমি ছিল না, তারাও এখন অনেক ধান গোলায় তুলছেন। প্রাকৃতিক আশির্বাদে এবার ডেমি ধান পেয়ে গরীব পরিবারের মানুষজনের মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের হাসি।
২৯ মে ও ১৫ জ্যৈষ্ঠ সোমবার নলুয়ার হাওর সহ বিভিন্ন হাওরে গিয়ে দেখা যায়, যে যেভাবে পারছেন নৌকা দিয়ে ডেমি ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় আলা উদ্দিন, আবদুল খালিক, ছলিম উল্লাহ, রবি দাস সহ হাওর পারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাওরে ডেমি ধান কাটতে আসা মানুষজন বলেন, ডেমি ধান পাওয়া এতো সোজা কথা নয়। ধান কাটার পর মানুষ হাওরে অবাদে গরু-বাছুর ছেড়ে দেয়। যেসব জমিতে গরু-বাছুর নামে সেখানে ডেমি ধান খেয়ে ফেলে। তাই ডেমি ধান পেতে হলে গভীর হাওরে যেতে হয়। যেখানে গরু-বাছুর যেতে পারে না। তার উপর হাওরে মেঘের পানি জমে আছে। নৌকা দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে। এছাড়া মূল ধানের মতো ডেমি ধান হয় না। তাই কুড়িয়ে কুড়িয়ে ডেমি ধান কাটতে হয়। যদিও ডেমি ধানের ছড়া ছোট হলেও ধান ভালো হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ডেমি কাটতে গেলে জমির মালিককে বলার প্রয়োজন হয় না। কারণ মূল ধান কাটার পর কেউ জমির খবর রাখেন না। তারা আরো জানান, সারাদিনে অনুমান জনপ্রতি এক থেকে দুই মণ কাটতে পারি। শুরু থেকে এ পর্যন্ত জনপ্রতি প্রায় ১৫ থেকে ২০ মণ ধান তাদের গোলায় উঠেছে বলে অনেকে জানান। এঁদের মধ্যে অনেকে বৈশাখ মাসে ধান পাননি। তাদের জমি আবাদের ক্ষমতা নেই। বৈশাখ মাসে ধানের বিনিময়ে তারা ধানকাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে ধান তুলতেন। তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় দেনি কাটা ও ভাগে কাটা কামলা বলা হয়। এবার হারভেষ্টার মেশিন দিয়ে বেশির ভাগ ধান কাটা হয়েছে। যে কারণে এসব দেনি ও ভাগে কাটা শ্রমিকদের মধ্যে অনেকে কাজ পাননি অথবা টাকার বিনিময়ে ধান কেটেছিলেন। ফলে তাদের ঘরে ধান উঠেনি। তবে প্রকৃতির আশির্বাদে ডেমি ধান পেয়ে এখন তাঁদের গোলাও ধান উঠছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাওসার আহমেদ বলেন, সুবর্ণ সম্ভাবনা হচ্ছে ডেমি ধান। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দরিদ্র মানুষের ঘরেও এবার ধান উঠেছে। এটি অত্যান্ত ভালো দিক। এবার এখনো বন্যার পানি না আসায় হাওরে ডেমি ধান পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, মূল ধান কাটার ২০/২৫ দিনের মধ্যে ডেমি ধান কাটার উপযোগী হয়ে যায়। তবে ধান কাটার পর জমিতে এক সিট ইউরিয়া সার দিলে প্রতি কেয়ারে ৮ থেকে ১০ মণ ডেমি ধান পাওয়া যেতো। এ অঞ্চলের কৃষকরা ডেমি ধানের আশা করেন না বা প্রকৃতি বিরূপ হলে ডেমি ধান হয় না। তাই জমিতে সার না দেয়ায় তুলনামূলক ফলন কম হয়েছে। এতে অনুমান কেদার প্রতি ৪ থেকে ৫ মণ ধান হতে পারে।