কাজির বাজার ডেস্ক
তুফানী নায়েকের বাবার বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার দেওরাছড়া চা বাগানে। ছোটবেলায় তার হাতে বাদামি রঙের ছোট একটি রেখা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে ছোট রেখাটি বড় হতে থাকে। এক সময় এটি গোলাকার বস্তুর মতো হয়। তিনি নিজে বা পরিবারের সদস্যরা এটি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি। এরই মধ্যে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। বিয়ের সূত্রে তিনি চলে আসেন স্বামীর বাড়ি জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নের জাগছড়া চা বাগানে। সেখানে আসার পর স্বামীর পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে যান বাগানের ডিসপেনসারিতে। চিকিৎসার পর গোলাকার বাদামি বস্তুটি কিছুটা কমে আসে। তখনও তিনি বা তার স্বামীর পরিবারের কেউ জানতেন না যে তিনি শরীরে বহন করে চলেছেন কুষ্ঠ রোগ।
২০০২ সালে তুফানীর দুই হাত ও দুই পায়ের কিছু অংশে পুনরায় চামড়া ঝলসানোর মতো বাদামি দাগ ফুটে ওঠে। ওই দাগের অংশ প্রায় অবশ হয়ে যায়। এ অবস্থায় স্বামীর পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে যান শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। যেখানে গিয়ে প্রথম জানতে পারেন তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত।
তুফানীর দুই হাতের আঙুলগুলো এখন শক্ত ও বাঁকা হয়ে গেছে। বর্তমানে জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাস্থ ‘হীড বাংলাদেশ’ নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তত্ত¡াবধানে আছেন তিনি। তারা সরকারি চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি তুফানীর পরিচর্যাও করে যাচ্ছে।
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার সুরমা চা বাগানের বাসিন্দা রাসু মুন্ডা (৬৮)। একেবারে ছোটবেলাতে চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দেন। পরে এক চা কোম্পানির একটি বাগানে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কারখানায় কাজ শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর সেখানে দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে অবসরে রয়েছেন। ২০০৭-২০০৮ সালে রাসু কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। প্রথমদিকে তার হাত ও পায়ে লাল গোলাকৃতির কিছু একটা অনুভব করেন। পরে তা বেড়ে পুরো হাতের আঙুলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে গেলে জানতে পারেন তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। বাগানে এ কথা ছড়িয়ে পড়লে তিনি অনেকটা একাকি হয়ে পড়েন। ওই বাগানে এখন ২০ জন কুষ্ঠ রোগী।
শুধু তুফানী বা রসু নন, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত হীডের তত্ত¡াবধানে রয়েছেন তাদের মতো ২৪০ জন রোগী (চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী)। যার প্রায় ৯৫ শতাংশই জেলার বিভিন্ন চা বাগানে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিক। এর মধ্যে শিশুও রয়েছে কয়েকজন। তবে পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারী শ্রমিকরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত।
হীড বাংলাদেশের হিসাবে জেলার জুড়ী, কুলাউড়া, বড়লেখা, মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল এ সাত উপজেলায় কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা ২৪০ হলেও স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব মতে বর্তমানে এ জেলায় কুষ্ঠ রোগী রয়েছেন ১২২ জন। আর চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৪ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগ ও হীড বাংলাদেশের সূত্র থেকে জানা যায়, কুষ্ঠ রোগটি মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রোমাটোসিসের কারণে ঘটে। এটি ত্বক ও স্নায়ুর একটি সংক্রমণ। এই ব্যাধি ত্বক, শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি, পেরিফেরাল স্নায়ু, চোখ ও শ্বাসযন্ত্র প্রভাবিত করে। কুষ্ঠ শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে ও পোকামাকড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। আবার অনেকেই মনে করেন এটি ছোঁয়াচে রোগ। তবে সব কুষ্ঠ ছোঁয়াচে নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছরে বহু মানুষ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে শুধু শারীরিক যন্ত্রণাই নয়, মানসিক ও সামাজিক নিগ্রহের শিকার হতে হয় রোগীকে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি শনাক্ত হলে কুষ্ঠ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য একটি রোগ।
কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ : কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ হলো চামড়ায় ফ্যাকাসে দাগ দেখা দেয়, ত্বকে ছোট ছোট ফোঁড়ার মতো হয়, চামড়া শুষ্ক ও শক্ত হয়ে যায়, পায়ের পাতার নিচের অংশে ঘা হয়, মুখের বা কানের কিছু স্থান ফুলে যায়, চোখের পাপড়ি ও ভ্রু পড়ে যায়, সংক্রমিত স্থান অসাড়তা অনুভব ও ঘাম হয়, অনেকে পঙ্গু হয়ে যান। এছাড়া কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগীর পেশি দুর্বল হয়ে যায়, মুখের নার্ভ ও স্নায়ুতে প্রভাব পড়ায় অন্ধত্বের ঝুঁকি বাড়ে বহুগুণ। তবে এ রোগটি চিকিৎসাযোগ্য। এ রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীই প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে আসেন না। অনেকেই একেবারে শেষ পর্যায়ে আসেন। ফলে রোগীদের ভোগান্তি বৃদ্ধি পায়।
কুষ্ঠ জীবাণুঘটিত একটি রোগ। এই রোগের প্রতিষেধক বা টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি। এটি নির্মূল ও প্রতিরোধের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আক্রান্ত দেশসমূহ একযোগে কাজ করছে। ভয়, কুসংস্কার এবং লজ্জার কারণে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তরা এটিকে প্রকাশ করতে চান না বা চিকিৎসা গ্রহণে কুণ্ঠাবোধ করেন।
কুষ্ঠ রোগ প্রতিরোধে দরকার সচেতনতা : চা বাগানে এ রোগটি আক্রান্ত কেন বেশি হয় জানতে চাইলে হীড বাংলাদেশের লিয়াজোঁ অফিসার নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘চা বাগানের শ্রমিকদের অনেক সময় ভিড়ের মধ্যে কাজ করতে হয়। তাদের উপযুক্ত খাবার, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য সুবিধার অভাব থাকে। তাই তারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রচলিত ওষুধ এ রোগের অগ্রগতি অনেকাংশে বন্ধ করতে পারে। সবাইকে উপযুক্ত খাবার, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এছাড়া এ রোগটির প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা গ্রহণ ও সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই।’
মৌলভীবাজারের সাত উপজেলায় কুষ্ঠ রোগ নিয়ে কাজ করছে হীড বাংলাদেশ। এ সংস্থার হিসাব মতে, তাদের তত্ত¡াবধানে বর্তমানে কুষ্ঠ রোগী রয়েছেন ২৪০ জন। তাদের দেখাশুনা, খোঁজ রাখা, পরিচর্যা করা, চিকিৎসা কিট প্রদান ইত্যাদি কাজে হীডকে সহায়তা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘স্বজন’ নামের একটি সমিতি। এ সমিতির সদস্যদের সবাই কুষ্ঠ রোগী। সমিতির সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্বর্ণবালা সিং। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে এ রোগে আক্রান্ত। তিনি জানালেন, ছোটবেলাতেই তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। তার পিঠে এ রোগটি ধরা পড়ে। কিন্তু এ রোগ সম্পর্কে তার বা তার বাবার পরিবারের কোনও ধারণা না থাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও চিকিৎসা নিতে পারেননি। ২০১২ সালে তার বিয়ে হয় জেলার জাগছড়া চা বাগানে। বিয়ের কিছুদিন পর স্বর্ণবালার পিঠের সমস্যা বুঝতে পেরে তার স্বামী যুগল সিং রাউতিয়া তাকে নিয়ে যান চিকিৎসকের কাছে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান তিনি কুষ্ঠ রোগী।
মাসের কিছু সময় তার কাটে কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগীদের সান্নিধ্যে। তাদের নিয়ে আনন্দ করেন, সেবা করেন, হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘হীড বাংলাদেশের দেশি-বিদেশি কর্মকর্তারা মাসে দু’চারবার ছুটে আসেন মাঠ পর্যায়ে কুষ্ঠ রোগীদের দ্বারপ্রান্তে। এতে রোগীরা মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকেন।’
শমশেরনগর চা বাগানের শ্রমিক নেতা ও শমসেরনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সিতারাম বীন বলেন, ‘চা বাগানের অধিকাংশ শ্রমিক নিরক্ষর। তারা নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে গাদাগাদি করে বাস করেন এবং এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে কুষ্ঠ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন চা শ্রমিকরা।’
হীড বাংলাদেশ’র প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর পরেশ দেবনাথ বলেন, ‘মৌলভীবাজার জেলার চা বাগানগুলোতে গড় হিসাবে প্রতি ১০০ জন শ্রমিকের মধ্যে দুই জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। কুষ্ঠ রোগ নির্মূলে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে নতুনভাবে লেপ্রসি ইন্টিগ্রেশন প্রজেক্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলায় কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা ২৪০ জন। এর আগে অসংখ্য রোগী পরিপূর্ণ সুস্থ্ হয়ে উঠেছেন।
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে রোগী ছিলেন ১০৫ জন, ২০২১ সালে ২৫৭ জন, ২০২০ সালে ১৯১ জন ও ২০১৯ সালে ৩৫৪ জন। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম সীমিত থাকায় রোগীর তথ্য পরিপূর্ণ করা সম্ভব হয়নি।’
তবে রোগীর এ সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালের কুষ্ঠ রোগ প্রকল্পের কর্মকর্তা জাকারিয়া আহমদ বলেন, ‘২০২৩ সালে হীড বাংলাদেশ পুরো জেলায় ২৪০ জন রোগীর কথা বললেও আমাদের সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ জেলায় বর্তমানে মোট কুষ্ঠ রোগী ১২২ জন। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে আমাদের হিসাব অনুযায়ী রোগীর সংখ্যা ছিল ১৮৯ জন। কিন্তু হীডের হিসাবে ১০৫ জন। আমাদের হিসাব ও জরিপ অনুযায়ী এসব রোগীদের নিয়মিত চেকআপ, চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলো থেকে।’
কুষ্ঠ রোগী বেশি মৌলভীবাজারে : মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মোর্শেদ বলেন, ‘কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে দেশে শীর্ষে রয়েছে মৌলভীবাজার। বর্তমানে জেলায় যেসব রোগী রয়েছেন তাদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কই বেশি। দেশের নয়টি জেলা কুষ্ঠ রোগের রেড জোনে রয়েছে। এ জেলায় কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে চা বাগান এলাকাতেই রয়েছেন ৯০ শতাংশের উপরে রোগী।’
তিনি বলেন, ‘মৌলভীবাজারসহ সারাদেশে শনাক্ত কুষ্ঠ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে চিকিৎসাধীন এবং শনাক্তের বাইরে থাকা রোগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। এছাড়া সংক্রামক এ রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। অধিকাংশ রোগী সমাজ ও নিজের পরিবারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আমরা চিকিৎসার পাশাপাশি রোগী ও তাদের পরিবারকে সচেতন করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছি। পরিস্থিতির উন্নয়নে স্বাস্থ্য বিভাগ সক্রিয় রয়েছে।’
দেশি চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, ‘কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত অনেক চা শ্রমিকরা সামাজিক কুসংস্কারের কারণে সঠিকভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা করতে চান না। আমরা এ ব্যাপারে তাদের সঠিকভাবে চিকিৎসা নিতে উদ্ধুদ্ধ করছি।’