দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

8

খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে বাংলাদেশে। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ।
দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান এবং সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও কৃষি খাতের উন্নয়নে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রতিবছর বাড়ছে। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও কৃষি খাতের উন্নয়নে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে। সব জাতের ধান, গম ও ভুট্টার উৎপাদনে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। আর খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগে দেশের লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি। ৫২ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে অন্তত তিনগুণ। যে দেশের মানুষ বহু বছর ধরে অর্ধাহার-অনাহারে কাটাত, সে দেশে খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ স্বাধীনতার পর প্রায় দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জনে সহায়তা করেছে। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতিও এ কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার।
এদিকে দেশে কৃষিঋণ বিতরণে গতি বেড়েছে আশাব্যঞ্জক হারে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রæয়ারি) কৃষি ও পল্লী খাতে ২১ হাজার ৬৬ কোটি টাকা কৃষিঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো- যা লক্ষ্যমাত্রার ৬৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ পদ্ধতিও সহজ করা হয়েছে কৃষকের জন্য। কৃষিঋণ আদায়ের হারও সন্তোজনকÑ ৪১ শতাংশের বেশি।
অন্যদিকে সরকার চলতি বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকা নগদ প্রণোদনা দিয়েছে ২৭ লাখ কৃষককে। এর আওতায় প্রত্যেক কৃষক বিঘাপ্রতি চাষের জন্য ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার পেয়েছেন বিনামূল্যে। দেওয়া হচ্ছে স্বল্পসুদে কৃষিযন্ত্র কেনার সুবিধাও। কৃষকদের ৫০ শতাংশের বেশি প্রণোদনা বিতরণ করা হয়েছে ইতোমধ্যে। সবাইকে সব সময় মনে রাখতে হবে, কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনীশক্তি ও মূল চালক।
করোনা অতিমারীর ভয়ঙ্কর দুর্বিপাকসহ বিভিন্ন জাতীয় অর্থনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মন্দাবস্থা, সর্বোপরি খাদ্যাভাব মোকাবিলায় দিন-রাত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশের মানুষকে। কৃষি ও কৃষকরাই নিরন্তর অবদান রেখে চলেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে।
কোভিড-১৯ অতিমারী-পরবর্তী চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে বেড়েছে জ্বালানি তেল-গ্যাসসহ খাদ্যশস্য ও নিত্যপণ্যের দাম। বিশ্বব্যাপী বিরাজমান মন্দাবস্থা। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাসহ খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার সতর্কবার্তাও উচ্চারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে। এই আশঙ্কা আমলে নিয়ে সরকার সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে দেশেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। ধান-চাল, শাকসবজি, ফলমূল ও মাছ উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর হলেও গম, ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ কিছু নিত্যপণ্য আমদানি করতে হয় এখনো। সরকার পর্যায়ক্রমে এসব ঘাটতিও কমিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। ধান-চালের পাশাপাশি গম, তেলবীজ ও অন্যান্য সহযোগী ফসল উৎপাদনে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ্ব ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি-ফাও (ডবিøউএফপি) বলেছে, অন্তত ৩৬টি দেশÑ যার মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে যদি না সময়োচিত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। উল্লেখ্য, বর্তমানে বিশ্বে সাড়ে ১৩ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে। আগামীতে তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে সাড়ে ২৬ কোটিতে। আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ এদিক থেকে রয়েছে সন্তোষজনক অবস্থানে। দেশ বর্তমানে খাদ্য, বিশেষ করে ধান-চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বাধিক জোর দিয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে হবে সর্বোচ্চ মাত্রায় ফসল উৎপাদনের ওপর।