মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
রমজান পাপ মোচনের মাস। ক্ষমা লাভের মাস। এ মাসে আল্লাহতায়ালা ক্ষমার দুয়ার অবারিত করেন। রোজার বিনিময়ে বান্দার গোনাহ মাফ করেন। তারাবি আদায়ে মুছে দেন সব আবিলতা। অন্যকে সেহরি-ইফতারে শরিক করালে দেন ক্ষমার সঙ্গে অবারিত নেকি। তাই রমজানের প্রতিটি মুহ‚র্তই বরকতপূর্ণ ও ক্ষমা লাভের স্বর্ণ সময়। তবে শেষ দশক আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ইবাদতের জোর প্রস্তুতি নেওয়া : বিশেষত শেষ দশক হলো, এ মাসের সবচেয়ে গুরুত্ববহ ও আবেদনময় সময়। এ সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইবাদত-বন্দেগি হতো বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এমনকি রমজানের প্রথম বিশদিন থেকেও আলাদা বোঝা যেত শেষ দশদিনের ইবাদত-নিমগ্নতা। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এত বেশি ইবাদত করতেন, যা বছরের অন্য সময়ে করতেন না।’ (মুসলিম : ১১৭৫)। তিনি আরও বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবাদতের জোর প্রস্তুতি নিতেন। নিজে রাত্রি জাগরণ করতেন। পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে তুলতেন।’ (বোখারি : ২০২৪)।
খাঁটি অন্তরে তওবা করা : মানুষের থেকে গোনাহ সংঘটিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ওই বান্দা, যে গোনাহ হয়ে গেলে আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে এবং আর কখনও গোনাহ না করার দৃঢ় সঙ্কল্প করে। এটাই প্রকৃত তওবা। তাই তওবার নিয়তে দু’রাকাত নামাজ পড়া উত্তম। পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দোয়া করা চাই। জায়েদ (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি এ দোয়া পড়ে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়; যদি সে রণক্ষেত্রও থেকে পলায়ন করে থাকে; দোয়াটি হচ্ছেÑ
আসতাগফিরুল্লাহাল আজিম, আল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি।
অর্থাৎ মহান আল্লাহর কাছে আমি ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; যিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং আমি তাঁর কাছে তওবা করি। (তিরমিজি : ৩৫৭৭)।
শেষ দশকে ইতেকাফ : লাইলাতুল কদরের কল্যাণ যেন আমাদের ছুঁয়ে যায়। তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ দশকে ইতেকাফের আমল দিয়েছেন। গুরুত্বের সঙ্গে অন্যকেও আমল করে শিখিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (বোখারি : ২০২৫)।
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। আর বলতেন, তোমরা এ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (বোখারি : ২০২০)। তিনি আরও বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ইন্তেকাল পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন, তারপর তার স্ত্রীগণও ইতিকাফ করেছেন।’ (বোখারি : ২০২৬)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওফাতের বছরে বিশদিন ইতেকাফ করেন।’ (বোখারি : ২০৪৪)।
শবে কদরের খোঁজ করা : শেষ দশকের ইবাদতের অন্যতম হলো, শবে কদর তালাশ করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কদর রাতের সন্ধান পেতে চায়, সে যেন রমজানের শেষ দশকে খুঁজে নেয়।’ (বোখারি : ১১৫৮)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বোখারি : ২০১৭)। অন্য হাদিসে বলেন, ‘এ রাত হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। যে এর কল্যাণ অর্জন করতে পারবে না, তার সব কল্যাণই হাতছাড়া হয়। সত্যিকার হতভাগা ছাড়া আর কেউ এর কল্যাণ বঞ্চিত হয় না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৪৪)।
আয়েশা (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, যদি আমি শবে কদর পেয়ে যাই, তাহলে কী দোয়া করব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নি। অর্থাৎ : হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাকারী, ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব, আমায় ক্ষমা করুন। (তিরমিজি : ৩৫১৩)।
সদকাতুল ফিতর আদায় করা : শেষ দশকের অন্যতম আমল হলো, সদকাতুল ফিতর আদায় করা। সামর্থ্যবান প্রতিজন নারী-পুরুষ ছোট-বড় সবার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা আবশ্যক করেছেন। সেই সঙ্গে নির্দেশ করেছেন, যেন তা ঈদুল ফিতরের নামাজের আগেই আদায় করা হয়। (বোখারি : ১৫০৩)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করেছেন; যাতে এটা রোজাদারের রোজার বিচ্যুতি তথা অনর্থক কথা-কাজ ও অশালীন আচরণের ক্ষতিপূরণ হয়। আর অসহায় মানুষের খাবারের সুন্দর ব্যবস্থা হয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬০৯)।
আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আমরা ঈদুল ফিতরের দিনে খাদ্যদ্রব্যের এক সা অথবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর অথবা এক সা পনির, অথবা এক সা কিসমিস সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।’ (বোখারি : ১৫০৫)। সদকাতুল ফিতর আদায়ে সামর্থ্যবানদের উচিত, ফিতরার সর্বনিম্ন হারকে নিজেদের জন্য গ্রহণ না করে, ফিতরার উচ্চ হারগুলো প্রতিষ্ঠিত করা। যাতে সমাজের অসহায় মানুষরা বেশি লাভবান হয়।