কাজিরবাজার ডেস্ক
করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা শুরু করল, ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধÑযার কঠিন প্রভাব পড়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের ঘনিষ্টতার জেরে গত ২৪ ফেব্রæয়ারি প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রটিতে সামরিক অভিযান শুরু করে রুশ বাহিনী। শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধ বাঁধার অল্প সময়ের মধ্যে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ রাশিয়ার ওপর একরাশ শাস্তিমূলক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ফলে অস্থির হয়ে ওঠে জ্বালানী তেলের বৈশ্বিক বাজার। খাদ্যপণ্য ও সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
এ সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হতে থাকে। মূল্যস্ফীতির জেরে জ্বালানিসহ যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম লাগামহীন ভাবে বাড়তে থাকে।
সবমিলিয়ে গত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরে নানামূখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাবনার শুরুতেই এই যুদ্ধ পরিস্থিতিকে গুরুত্বপূর্ণ সংকট বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
অস্থির হয়ে উঠেছে গমের বাজার। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায় ৬৮% চালের ওপর নির্ভর করে এবং প্রায় ৭% জোগান আসে গম থেকে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ বছরে দেশে গমের চাহিদা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
এই চাহিদার প্রায় সবটুকুই আমদানি করে বাংলাদেশ। ট্রেড ডাটা মনিটরের ইউএসডিএ রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে তার চাহিদার ৮৭% গম আমদানি করে। এই গমের অর্ধেক আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে।
বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্ববাজারে মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ গম সরবরাহ করে রাশিয়া; কিন্তু যুদ্ধের ফলে দেশ দুটি থেকে এই পণ্যটির সরবরাহ ব্যহত হওয়ায় বাংলাদেশে গমের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
ফলে আটা-ময়দার পাশাপাশি বেকারি পণ্যের দামও হু হু করে বেড়ে গেছে বাংলাদেশে। যুদ্ধের আগে যে প্যাকেটজাত আটার দাম কেজি প্রতি ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা।
দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেশটির সাধারণ মানুষ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেন, ‘গমের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে চালের দামও প্রতিবেশী যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি হারে বেড়েছে। এই দাম বাড়ার কারণ চালের সরবরাহ ঘাটতি নয়।
‘ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে বলেই আমার ধারণা। এদিকে খাবারের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে মানুষের জন্য জীবন ধারণ ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।’
ঘোলাটে পরিস্থিতি ভোজ্যতেলের বাজারে। যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়ে মধ্যে পড়েছে ভোজ্যতেলের বাজারও। বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ সরবরাহ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। বাংলাদেশে সূর্যমুখী তেল তেমন আমদানি করে না; কিন্তু তা সত্তে¡ও সূর্যমূখী তেলের দাম বৃদ্ধির জেরে প অন্য সব ভোজ্যতেলের বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
ভোজ্য তেল হিসেবে বাংলাদেশে পাম তেল ও সয়াবিন তেলের ব্যবহার বেশি। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে এসব ভোজ্যতেলের কাঁচা তেলবীজ আমদানি করে অভ্যন্তরীণভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে অল্প পরিমাণে তেলের বীজ কেনে, সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত সয়াবিন কেনে আর্জেন্টিনা থেকে, আর সয়াবিনের বীজ কেনে ব্রাজিল থেকে।
যুদ্ধের জেরে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে পাম তেল এবং সয়াবিন তেলের চাহিদা ও দাম দুটোই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি পাম তেলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ে।
অথচ বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেল লাগে। তার মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন হয় মাত্র দুই থেকে তিন লাখ টন। আর বাকি পুরোটাই, অর্থাৎ চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করতে হয় আমদানি থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে পাম ও সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যায়। তার ওপর ভোজ্যতেল রফতানিকারক দেশগুলোর আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা পণ্য সংকটের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশে আমিষের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হয়ে থাকে ব্রয়লার মুরগি থেকে, যা সাধারণভাবে ‘ফার্মের মুরগি’ নামে পরিচিত। এই মুরগির দামও এখন চলে গেছে নাগালের বাইরে। মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা মুরগির খাবারের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন। বাংলাদেশে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের ৬০% উপকরণ আমদানি করতে হয়। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে ভুট্টা।
বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬% ভুট্টা সরবরাহ করে। এরমধ্যে বাংলাদেশও চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে ইউক্রেন থেকেই। সার সঙ্কটে ঝুঁকিতে কৃষি। বাংলাদেশের কৃষি, বিশেষ করে ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল এবং প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সারের একটি বড় অংশ আমদানি করা হয় রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট তথ্যমতে, বাংলাদেশে বছরে প্রতি হেক্টর ফসল চাষে গড় ২৮৬ কেজি সার ব্যবহার করতে হয়, যার বড় অংশ জুড়েই থাকে পটাশ সার। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সার কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই সার আমদানি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ। ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে প্রতিবছর ১২ লাখ টনেরও বেশি সার আমদানি করে। শতকরা হিসেবে এটি দেশের মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশেরও বেশি।
কিন্তু যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ায় দেশটি থেকে সার আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে সার আমদানি বাবদ অধিক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে এবং এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
মহামারিকালে আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৫০ ডলারের নিচে। গত বছরের ৫ই মার্চ, অর্থাৎ যুদ্ধ বাঁধার পরপর প্রতি ব্যারেল ব্রেন্টের দাম গিয়ে ঠেকে ১৩৯ ডলারে। তারপর ৬ মাসেরও বেশি সময় তেলের দর ১১০ থেকে ১২০ ডলারের মধ্যেই ওঠানামা করতে থাকে।
ঠিক সে সময় বাংলাদেশেও সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৪২.৫% থেকে ৫১.৫% বাড়ানো হয়। গত বছরের ৫ই আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘সরকারের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।’ তবে এই পরিস্থিতিতেও কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে জ্বালানি আমদানিতে ভর্তুকি দেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘কৃষিতে সেচের জন্য যে পরিমাণ জ্বালানি দরকারÑতার চেয়ে কম জ্বালানি আমদানি করা হচ্ছে। এতে বোরো মৌসুমে প্রভাব পড়তে পারে।’ ‘জ্বালানির দাম বাড়লে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে, ফলে চালের দামও বাড়বে। তাই অন্তত চালের দাম নাগালে রাখতে সরকারকে ডিজেলের ওপর ভর্তুকি দিতে হবে।’
ডলার সংকটে বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। তেলের কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় একই পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বাড়তি ডলার খরচ করতে হচ্ছে, অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বেড়েছে।
কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি না বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করে।
এই সুইফট বা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টার-ব্যাংক ফিনানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন হলো ২০০টি দেশে ব্যবহৃত একটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ম্যাসেজিং সিস্টেম, যা কোনও আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের তথ্য ওই অর্থের প্রেরক এবং প্রাপককে ক্ষুদে বার্তা বা মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। এতে অর্থ লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
রাশিয়া প্রতিদিন এই সুইফটের মাধ্যমে লাখ লাখ লেনদেন সম্পন্ন করতো। কিন্তু এই সুইফটে নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের যেসব পোশাকের অর্ডার শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, তার মূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সুইফটকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে ভিসা এবং মাস্টারকার্ডও রাশিয়ান অর্থনৈতিক লেনদেন করা বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের অর্ধেকের বেশি বা ৬৪% তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অর্থনীতিতে মন্দাভাব চলে আসায় ইউরোপীয়দের ক্রয়ক্ষমতায় লাগাম পড়েছে। ফলে বাংলাদেশে নতুন অর্ডারের হারও কমেছে। এই যুদ্ধের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২সহ যেসব প্রকল্পে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, সেগুলো দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি, এই যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা কমে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যুদ্ধের বহুমাত্রিক প্রভাব খুব সহসা কাটছে না। এক্ষেত্রে তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সমন্বিতভাবে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হাতে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বিবিসিকে খন্দকার মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বেসরকারি কোম্পানিগুলো যেন বড় ছাঁটাইয়ে না যায়। সরকার কর্মসংস্থান অব্যাহত রাখতে প্রণোদনা দিতে পারে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা সেটা নজরদারি করা প্রয়োজন যেন কেউ এর থেকে রাজনৈতিক সুবিধা না নেয়।’