কাজিরবাজার ডেস্ক
বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন (রিজার্ভ) এক বিপজ্জনক বাঁক অতিক্রম করেছে। অবনতিবস্থা কাটিয়ে ক্রমশই স্থিতিশীল হচ্ছে রিজার্ভ।
আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো উৎসাহিত করতে নানামুখী কার্যক্রম, রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত, আন্তর্জাতিদক মুদ্রা তহবিল থেকে দ্রæত ঋণের অর্থ ছাড় এবং সর্বোপরি গৃহীত উদ্যোগে আস্থা ফেরায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সামনের দিকে হাঁটা শুরু করেছে।
বর্তমানে দেশের রিজার্ভ রয়েছে ৩২ দশমিক ২২৩ বিলিয়ন ডলার। আগের মাসগুলোতে রিজার্ভ বেশি ছিল এবং আমদানি ব্যয় মেটানোর ফলে ক্রমান্বয়ে কমেছে। তবে কমার পথগুলো বন্ধ হয়েছে, রিজার্ভ এখন ঠিক দিকে হাঁটছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
তিনি বলেন, বিনিময় হার নমনীয় ও একদরের দিকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ, সুদ হার বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ ও প্রবাসী আয় পাঠানো সহজ করায় রেমিট্যান্স আসা আগামীতে ক্রমান্বয়ে বাড়বে। আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে রিজার্ভে।
প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বৈদেশিক রিজার্ভের বড় মাধ্যম। যা তুলনামূলক কম ডলার ব্যয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি ৭ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ দশমিক ৫০৪ বিলিয়র ডলার। আর চলতি ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথম ১৭দিনে প্রবাসীরা দেশ পাঠিয়েছেন ১ দশমিক শূন্য ৫১ বিলিয়ন ডলার। আগস্ট পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে কিছুটা নিম্নমুখী হয়। তবে ডিসেম্বর মাস থেকে তা কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। ফেব্রæয়ারি মাসেও সেই ধারা অব্যাহত আছে।
সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয় নিম্নমুখী হয় মূলত ডলার বাজার অস্থির হওয়ার কারণে। এ সময়ে আমদানি ব্যয় মেটানোর বাড়তি চাপ অব্যাহত ছিল। ফলে রিজার্ভে ঝুঁকি তৈরি হতে থাকে। হুন্ডি মার্কেটের দৌরাত্মাও চরমে ওঠার কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে হুন্ডি ও অবৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা; রেমিট্যান্সে প্রণোদনা দুই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা; রেমিট্যান্স পাঠাতে ফি প্রত্যাহারও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানোর মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে এর সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। বাড়ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো ঠেকাতে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার (বিএফআইইউ) বিভিন্ন উদ্যোগের কাজ দিচ্ছে।
জানা গেছে, বিএফআইইউ এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন ৫ হাজার ৭৬৬ জন এজেন্ট চিহ্নিত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে পাঠায়। এর মধ্যে হুন্ডির সঙ্গে জড়িত ২ হাজার ২৬৬ জন এজেন্ট এবং তিনজন ডিস্ট্রিবিউটরের এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়। বিএফআইইউ যে ৫ হাজার ৫৫৭ সুবিধাভোগীর এমএফএস হিসাব অবরুদ্ধ করেছিল, সেখানে জমার পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। এদের মধ্যে ২ হাজার ৯৫৩টি হিসাব সচল করা হয়েছে। বাকি ২ হাজার ৬১৪টি হিসাবে শুধু উত্তোলন বন্ধ আছে। এর মধ্যে ৮০০ জনের বেশি হিসাবধারী তাদের হিসাব সচল করার লিখিত আবেদন করেছেন। বিএফআইইউর কাছে যা বর্তমানে বিবেচনাধীন রয়েছে। পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা সে তথ্য খতিয়ে দেখছে আর্থিক গোয়ন্দো সংস্থা বিএফআইইউ। আতিউর রহমান বলেন, সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো ঠিক জায়গা। আরও আগে এসব উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করা হয়েছে। এটা একদরের দিকে যাচ্ছে। ফলে যারা ডলার কিনে মজুদ করতো তারা আর তা করবে না। এই ভেবে মজুদ করবে না যে, ‘কিনলেই কম দামে বিক্রি করতে হবে’।
তিনি বলেন, সুদ হার নমনীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটা বিনিময়ে হারের ওপরে আরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
যারা রেমিট্যান্স পাঠান, তাদের আরও বেশি হারে পাঠানোর জন্য মোবাইল ফাইনান্সিং সার্ভিস মতো মাধ্যম চালু হয়েছে এগুলো আরও সহজতর করতে হবে, যোগ করে আতিউর রহমান বলেন, প্রবাসীদের মধ্যে যাদের আয় রোজাগার বেশি, তারা যেন ট্রেজারি বন্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ড-বিল ডিজিটাল মাধ্যমে আরও তাড়াতাড়ি কিনতে পারে এটাও নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে দেশে আরও অনেক ডলার আসবে এবং রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে যে সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো অব্যাহত রাখত হবে।
দেশের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যম হলো রপ্তানি আয়। চলতি বছরে রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই-জানুয়ারি সাত মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩২ দশমিক ৪৪৭ বিলিয়ন ডলার। যা রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ছুঁয়েছে। সেই সঙ্গে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে অপ্রয়োজনীয়, বিলাসী পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। কোনো কোনো পণ্যে একশ ভাগ পর্যন্ত মার্জিন বাধ্যতামূলক করা হয়। আমদানি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ৫০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি মূল্য দেখানোর বিষয় সামনে আসে। আমদানির নামে এসব প্রতিষ্ঠান ওভার-ইনভয়েজের মাধ্যমে টাকা পাচার করছিল। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। এর ফলে আমদানি ব্যয় কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বেশেষ তথ্য অনুযায়ী, উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা। পূর্বে খোলা ঋণপত্রের দায় পরিশোধ করতে এখনো উল্লেখযোগ্য হারে বৈদেশিক মুদ্রা গোনা লাগছে। ইতোমধ্যে এ আমদানি দায় পরিশোধের হার কমে আসছে। নতুন এলসি খোলার দায় পুরোপুরি পরিশোধ শুরু হলে আমদানি ব্যয় গুনতে রিজার্ভের ওপরে চাপ কমে যাবে। তখন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিও কমবে।
রিজার্ভে ঝুঁকি কমছে। এর মূলে রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় আস্থা ফেরানো। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন রকম উদ্যোগনেওয়া ও চাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবিলের (আইএমএফ) অনুমোদন ও ঋণ দ্রæত ছাড়ের ফলে বহুজাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন দেশের অর্থনীতির অভ্যান্তরীণ শক্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। দেশের ভেতরেও আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে।
এসব উদ্যোগের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন (রিজার্ভ) আরও বাড়বে। কেটে যাবে অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, গৃহীত উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। সামনে রোজা ও ঈদ। সে সময় প্রবাসীরা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাবেন। এতে আগামী কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। ফলে রিজার্ভ আরও স্বস্তিদায়ক অবস্থানে ফিরবে।
অর্থনৈতিক সংস্কারের শর্তে ঋণ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তারা বলছে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর বিশ্লেষণ করে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে বহজাতিক এই অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানটি।