সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার কদমতলীতে স্থাপত্যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে নির্মিত কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল শীঘ্রই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। পুরানো বাস টার্মিনালের জায়গায়ই ৮ একর জায়গা জুড়ে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নতুন এই বাস টার্মিনালটি। টার্মিনাল নির্মাণের পুরো টাকাই অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। ২০২০ সালের মধ্যে এই টার্মিনালের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা ও বন্যার কারণে এত দিন পিছিয়ে যায় দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিতার এই বাস টার্মিনালটি।
বুধবার ৪ জানুয়ারী দৃষ্টিনন্দন কেন্দ্রীয় এই বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, নির্মিত্ত্ব টার্মিনালটির পরিষ্কার-পরিছন্নতার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। যাত্রীদের গাড়ীর রাখার স্থানে রুড মার্কিং করা হচ্ছে। রাস্তা, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য কাজে ব্যবস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা।
সিলেটের ঐতিহ্য আসাম টাইপ বাড়ি আর চাঁদনীঘাটের আলী আমজদের ঘড়ির এই দুই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয় ঘটিয়ে নির্মিত হয় এই কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালটি। দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক এই বাস টার্মিনালটির নকশা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষক। তারা হচ্ছেন, সুব্রত দাশ, রবিন দে ও মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।
সিসিক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে মিউনিসিপাল গভর্নমেন্ট সার্ভিস প্রজেক্ট (এমজিএসপি) প্রকল্পের আওতায় সিসিকের উদ্যোগে এই টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। ৬ তলা ভিত্তির ৩ তলা কমপ্লেক্স প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ঢাকার ডালি কনস্ট্রাকশন।
সরেজমিনে টার্মিনাল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। কারুকার্যময় লাল ইটের দেয়াল, ইট রঙের স্টিলের ছাউনি, গাছপালা আবৃত গ্রীন জোন, বিমানবন্দরের আদলে আলাদা প্রবেশ ও বহির্গমন পথ, যাত্রীদের জন্য প্রায় ১ হাজার ৫০০ আসনের বিশাল ওয়েটিং লাউঞ্জ রয়েছে এখানে।
সূত্র জানায়, এর আগে এই টার্মিনাল এলাকা ছিলো ময়লার ভাগাড়। বৃষ্টির দিনে কাদা আর পানিতে একাকার থাকতো পুরো এলাকা। আর এবড়ো-থেবড়োভাবে রাখা গাড়ির কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হতো যাত্রীদের। নতুন টার্মিনালে সবকিছুকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িতরা জানান, পুরো টার্মিনালের নির্মাণ কাজ তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম অংশের বহির্গমন ভবনের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩০০ ফুট। এই অংশে ৪৮টি বাস একসাথে থাকতে পারবে। এছাড়া যাত্রীদের বসার জন্য রয়েছে ৯৭০ আসনের বিশাল হল। রয়েছে ৩০ আসনের ভিআইপি কক্ষ, ৩০টি টিকিট কাউন্টার ও নামাজের জন্য আলাদা কক্ষ। পুরুষ, নারী ও বিশেষ সুবিধাসম্পন্নদের ব্যবহার উপযোগী ৬টি টয়লেটও থাকবে এখানে। প্রয়োজনে হুইল চেয়ার নিয়েও টয়লেট ব্যবহার করা যাবে। উপরে উঠার জন্য রয়েছে লিফট এবং খাবারের জন্য রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়া যাত্রীর জন্য আলাদা শয্যা ও ব্রেস্ট ফিডিং জোন থাকবে এখানে। দ্বিতীয় অংশের আগমনী ভবন প্রায় ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে। এখানে যাত্রীদের বসার জন্য ৫১০ আসনের বসার স্থান ও ৩০ আসনের ভিআইপি কক্ষ, আধুনিক টয়লেট সুবিধা, বুথ, ব্রেস্ট ফিডিং জোন, লিফট, রেস্টুরেন্টসহ অন্যান্য সুবিধা। আগমন ও বহির্গমন অংশ আলাদা করা হলেও করিডোরের মাধ্যমে পুরো স্থাপনাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এই বিল্ডিংয়ের পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে সড়কের সঙ্গে গোলাকার ৫ তলা টাওয়ার বিল্ডিংয়ে রয়েছে টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অফিস। যেখানে থাকবে পুরো টার্মিনালের সিকিউরিটি কন্ট্রোল ও সিসিটিভি মনিটরিং কক্ষ, পুলিশ কক্ষ এবং পর্যটন অফিস। টার্মিনালের পেছনের দিকে তৃতীয় অংশে নির্মিত হয়েছে একটি মাল্টিপারপাস ওয়েলফেয়ার সেন্টার। যেখানে মালিক ও চালক সমিতির জন্য থাকবে ২৪ বেডের বিশ্রাম কক্ষ, গোসলের ব্যবস্থা, অফিস, লকার ব্যবস্থা, ক্যান্টিন এবং মিটিং ও অনুষ্ঠানের জন্য মাল্টিপারপাস মিলনায়তন। এছাড়া টার্মিনালের পিছনে (উত্তর) রয়েছে নামাজ আদায় করার বিশাল একটি মজিদ, পূর্ব দিকে নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র এর দক্ষিণ পাশে রয়েছে এসএমপি দক্ষিণ সুরমা থানার কদমতলী পুলিশ ফাঁড়ি।
এদিকে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে ২৬ নং ওয়ার্কের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-১ তৌফিক বক্স লিপনের সভাপতিত্বে বাস মালিক সমিতি ও বাস শ্রমিক সংগঠনকে নিয়ে কদমতলী কেন্দ্রীয় আধুনিক এই বাস টার্মিনালটি পরিষ্কার পরিছন্ন রাখার বিষয়ে এক মতবিণিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব বলেন, যাত্রীদের গাড়ী উঠা-নামার জন্য রুড মার্কিং ও টার্মিনালের পরিষ্কার পরিছন্নতার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এছাড়া টার্মিনালে প্রবেশের সামনের রাস্তা ও সামনের আধুনিক গার্ড ওয়ালের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। তিনি বলেন, সামনের কাজ করার সময় অস্থায়ী বাস কাউন্টার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের নকশা প্রসঙ্গে সুব্রত দে বলেন, বাস টার্মিনালের নকশায় সিলেটের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। সিলেটের ঐতিহ্য আসাম টাইপ বাড়ি, চাঁদনীঘাটের ঘড়ির আদলে এর নকশা করা হয়েছে। একইসঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।
কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডালি কনস্ট্রাকশনের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, এ প্রকল্পের স্টিলের টিন আনা হয়েছে তাইওয়ান থেকে। স্টিল স্ট্রাকচারের জন্য লোহার বার আনা হয়েছে চায়না থেকে এবং প্রতিটি জিনিস বুয়েটে টেস্ট করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখানে বিমানবন্দরের মতো বিশাল ওয়েটিং স্পেস রাখা হয়েছে। আছে পার্কিং জোন। পরিবেশের কথা বিবেচনা করে ভবনের পেছনের দিকে রয়েছে গাছপালা আচ্ছাদিত গ্রীণ জোন। পরিবহন শ্রমিকদের জন্য মাল্টিপারপাস বিল্ডিংয়ে রয়েছে বিশাল হলরুম, অফিস, ওয়াশরুম, রেস্টরুমসহ বিভিন্ন সুবিধা।
বুধবার সিলেট সিটি করর্পোরেশনের (সিসিক) প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, সিলেট কেন্দ্রীয় এই বাস টার্মিনাল দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক বাস টার্মিনাল। এতে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীও সবার নজর কাড়বে। গত বছরের জুনেই এই বাস টার্মিনালের কাজ শেষ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, এখানে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা ও যাত্রী ওঠানামা করা যাবে না। ইচ্ছামতো কাউন্টার বসানো যাবে না। তিনি বলেন, রাস্তায় বাস রাখা মানুষ ও পথচারীদের অসুবিধার কারনে আগামীকাল ৭ জানুয়ারী টার্মিনালে বাস প্রবেশের কথা রয়েছে। টার্মিনালে ১০০টি বাস থাকবে। তবে শীঘ্রই এই আধুনিক টার্মিনাল উদ্বোধন হবে। তবে এই মুহুর্তে টার্মিনাল কবে উদ্বোধন হবে তার তারিখ বলা যাচ্ছে না। এ টার্মিনালের সামনের বাউন্ডারী দেওয়ালের ট্রেন্ডার আহবান করা হয় নাই তবে দিতে হবে।
নূর আজিজুর রহমান আরো বলেন, টার্মিনালের পরিষ্কার পরিছন্নতার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আর আধুনিক এই বাস টার্মিনালটি পরিষ্কার পরিছন্নতা রাখার জন্য বাস মালিক সমিতি ও বাস শ্রমিক সংগঠনকে নিয়ে কয়েক বার মতবিণিময় হয়েছে এবং এ মতবিনিময় এখনও অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, আধুনিকায়ন এই কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালটি নিরপত্তার জন্য পুলিশের পাশাপাশি সিলেট সিটি কর্পোরশনের নিজস্ব লোকও কাজ করবে। এছাড়া এই টার্মিনালটি পরিষ্কার পরিছন্নতার রাখা সকল নাগরিকের দায়িত্ব বলে জানালেন এই সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান।