কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন রেকর্ড আর বিতর্কে বছর কাটল ইসির

32

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সংসদ নির্বাচনের আগের বছরে নিয়োগ পেয়ে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সময় কাটল নানা রেকর্ড আর বিতর্কের মধ্যে। নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ করার উদ্যোগ সফল হলেও কারচুপি ঠেকাতে পারেনি কমিশন।
আবার সিসি ক্যামেরার ব্যবহারে আশার আলো মিললেও সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্প নেওয়ায় বিতর্ক পিছু ছাড়েনি।
সংলাপে সাড়া দেয়নি বিএনপি
আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নিয়েই রাজনীতিক, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৭ থেকে ৩১ জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানায় সংস্থাটি। এতে বিএনপিসহ নয়টি দল ইসির ডাকে সাড়া দেয়নি।
যেসব দল সংলাপে অংশ নিয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি করে। অনেকেই আপত্তি তোলে ইভিএম নিয়ে। কোনো কোনো দল সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে নির্বাচনের যুক্তি তুলে ধরে।
তবে নির্বাচন কমিশন সংবিধানের মধ্যে থেকেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, সেই যুক্তি তুলে ধরে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো মীমাংসার দায়িত্ব তাদের নয় বলে জানায়। একইসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানোর। বিষয়টিকে অনেকেই লোক দেখানো সংলাপ বলেও মন্তব্য করেন।
সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ
আউয়াল কমিশন কেবল সংলাপই দ্রæত করেননি। তার ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনের একটি রোডম্যাপও প্রায় দেড় বছর আগে তৈরি করেছে। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তাদের সব উদ্যোগ, পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে কখন কোন কাজ কমিশন করবে, তা জানাতে সাধারণের জন্য রোডম্যাপ প্রকাশও করেছে।
তলোয়ার-রাইফেল বিতর্ক
ববি হাজ্জাজের দল এনডিএমের সঙ্গে সংলাপে বসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল মন্তব্য করেন, ‘আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করবো?’ এই বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরবর্তীতে অবশ্য সিইসি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান।
কুসিক ভোটে ফল গণনায় গÐগোল
১৫ জুন অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ একটি ভোট আয়োজনের পর সাফল্যের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। সন্ধ্যার পর ভোট গণনার সময় ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর ‘অহেতুক’ ফল ঘোষণা বন্ধ রাখা হলে সন্দেহের দানা বাঁধে। এ নিয়ে হট্টগোলের সৃষ্টি হলে পুলিশ এসে নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি।
নির্বাচনে মাত্র ৩৪৩ ভোটে দুই বারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে (বিএনপি নেতা) হারিয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত। নির্বাচনে ফলাফল বর্জন করেন সাক্কু, যদিও এ নিয়ে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হননি। এই ঘটনা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
বাহাউদ্দিনের ‘বুড়ো আঙুল’
কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে কুসিক নির্বাচনী এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলে তিনি বুড়ো আঙুল দেখান নির্বাচন কমিশনকে। একইসঙ্গে ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের শরণাপন্ন হন বাহাউদ্দিন। একজন এমপিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ ইসি কী করে ৩০০ এমপিকে সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ন্ত্রণ করবেÑএই প্রশ্ন যখন সামনে আসে, ঠিক তখনই পুরো ইউটার্ন নেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল।
তিনি বলেন, বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেননি, তাকে অনুরোধ করেছেন। ভোটের এলাকায় কারো বাড়ি হলে বাড়িতে থাকতে বাধা নেই।
সিসি ক্যামেরায় ভালো সাড়া
কুসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রতিটি ভোটকক্ষ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে ভোটকেন্দ্রের বাইরে কোনো হট্টগোলের পরিস্থিতি হয়নি। ভোটগ্রহণ হয় সুশৃঙ্খলভাবে। কমিশনের এই উদ্যোগকে অনেকেই সাধুবাদ জানান।
গাইবান্ধায় রেকর্ড
১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচনে অতীতের সব ইতিহাস ছাপিয়ে নজির স্থাপন করে আউয়াল কমিশন। সিসি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণ করে ৫০টি কেন্দ্রে অনিয়মের চিত্র দেখতে পেয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তাও একটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে নির্বাচনের কোনো যৌক্তিকতা না থাকায় পুরো নির্বাচনের ভোটগ্রহণ বাতিল করে দেয় ইসি। একই সঙ্গে অনিয়মে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়।
৫১ কেন্দ্রের অনিয়ম তদন্তে ওই কমিটি ৬৮৫ জনের শুনানি করে এবং অন্যান্য কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ করে। যার ভিত্তিতে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ১৩৩ কর্মকর্তা বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সিদ্ধান্ত দেয় ইসি।
দেশের ইতিহাসে কোনো আসনের ভোট অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দেওয়া এটি একটি নজির। এছাড়া এত কর্মকর্তাকে শাস্তি আওতায় আনার সিদ্ধান্তও রেকর্ড।
নৌকার প্রতীকের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল
গত ২ জুন ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে নির্বাচনী অপরাধে লিপ্ত থাকায় নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মো. আব্দুল খালেকের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিষয়টি সকলের মাঝেই আউয়াল কমিশনের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে তোলে। তবে আদালত থেকে রায় নিয়ে পরবর্তীতে প্রার্থিতা ফিরে পান আব্দুল খালেক।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন
সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মতামত এবং বিএনপিসহ অন্যান্য দলের বিরোধিতা সত্তে¡ও আট হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার নতুন ইভিএম প্রকল্প হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রকল্প প্রস্তাবটি সরকারের তরফ থেকে অনুমোদন হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ইসির পরিকল্পনা হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে আরও দুই লাখ ইভিএম ক্রয় করে ১৫০ আসনে এই ভোটযন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করার।
দেশের সেরা প্রযুক্তিবিদরা এই মেশিনকে নির্ভরযোগ্য বললেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এর মাধ্যমে ভোট কারচুপি করা সম্ভব। এখন যুক্তি হিসেবে তারা গাইবান্ধার নির্বাচনকে সামনে আনছেন। বলা হচ্ছে কেন্দ্রের বাইরে কোনো হইচই না থাকলেও গোপন কক্ষে দুর্বিত্তরা অন্য জনের ভোট নিয়ে নিচ্ছেন। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, এই দুর্বৃত্ত ঠেকানো একটি চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ তারা একা মোকাবিলা করতে পারবে না। সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, দলগুলোকে সমানভাবে কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নিয়ে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে।
বিভিন্ন সংস্কার
নানা সমালোচনার মধ্যেও দমে যায়নি কমিশন। তারা নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আইনি সংস্কারসহ অন্যান্য পদক্ষেপের কথাও ভাবছেন, যা কমিশনের ইমেজকে ইতিবাচক করে তুলছে বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন, ভোটে স্কাউট, বিএনসিসিকে ব্যবহারে চিন্তা, ৩০০ আসনেই সিসি ক্যামেরার ব্যবহার অন্যতম।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর এসব নিয়ে বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা প্রয়োজন আমরা সকল উদ্যোগ নেবো। গত ফেব্রæয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমরা যে সকল ব্যবস্থা নিয়েছি, এতে আমরা কখনোই কোনো আইনের ব্যত্যয় করিনি। আগামীতেও ব্যত্যয় হবে না।