বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কৌশল নিয়ে বিপাকে পড়েছে মিত্ররা

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
যুগপৎভাবে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাওয়ার কৌশল অবলম্বন করায় বিপাকে পড়েছে তাদের মিত্র দলগুলো। নামসর্বস্ব মিত্র দলগুলোর আশঙ্কা, জোটে থেকে এসব দলের নেতারা বিএনপির কাছে সহজে যতটা গুরুত্ব পেতেন, সামনে আন্দোলনে তার প্রমাণ রাজপথে দেখাতে হবে। আর এই জায়গায় কাবু নামসর্বস্ব এসব দল। তাই বিএনপির আন্দোলনে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সমমনা দল নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক জোট। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ২০ দল ভেঙে দুইটি জোট গঠন- এটা আওয়ামী লীগের খেলার একটা অংশ। নিজেদের আন্দোলনের সক্ষমতা প্রমাণের জন্য নামসর্বস্ব দলের জোট তৈরি হয়েছে। বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ এদের ব্যবহার করতে পারে।
গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দুই জোট নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। নির্বাচনের পরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের জোট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে কিছুদিন পরে ওই জোট ভেঙে যায়। গত এক-দেড় বছর ধরে ২০ দলীয় জোটের কোনো কার্যক্রম নেই। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশানে দলীয় প্রধানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিএনপি এই মুহ‚র্তে আর কোনো জোটে নেই। বিএনপি এখন যুগপৎ আন্দোলন আছে।
গত এক-দেড় বছর ধরে ২০ দলীয় জোটের কোনো কার্যক্রম নেই। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশানে দলীয় প্রধানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিএনপি এই মুহ‚র্তে আর কোনো জোটে নেই। বিএনপি এখন যুগপৎ আন্দোলন আছে।
অবশ্য এর আগে থেকেই নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে ২০ দলীয় জোটের শরিক নেতারা স্পষ্ট করেছিলেন যে তাদের জোট আর থাকছে না। জোট থাকাকালে অর্থ, লোকবল, মঞ্চ বিএনপির। অথচ সেখানে অতিথি জোটের। বক্তৃতায় করতালি দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। কিন্তু নিজস্ব পরিসরে তাদের কর্মসূচি করার সক্ষমতা নেই। তাই জোট ভাঙার পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকেই ২০ দলীয় জোটের নামসর্বস্ব দলগুলোর নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে থাকে। করণীয় ঠিক করতে তারা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সমমনাদের নিয়ে জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
এরইমধ্যে গত ২২ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোটের ১২টি দল মিলে ১২ দলীয় জোটের ঘোষণা দিয়েছে। ১২ দলীয় এই জোটে রয়েছে- মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর), সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় দল, কে এম আবু তাহেরের নেতৃত্বে এনডিপি, এলডিপির (একাংশ), জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাওলানা আবদুর রকীবের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট, তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ও আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি।
বারো দলীয় এই জোটের আত্মপ্রকাশের সময় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, আগামী ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণমিছিল। আমরাও ১২ দল জোটবদ্ধভাবে গণমিছিল করবো। রাজধানীর বিজয়নগর মোড়ে আমাদের অবস্থান হবে।
নতুন এ জোটের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, যেহেতু বিএনপি যুগপৎভাবে আন্দোলনের কৌশল অবলম্বন করেছে, তাই আমরা ২০ দলীয় জোটের ১২টি দল মিলে জোট গঠন করেছি। বিএনপির আন্দোলনের যে সক্ষমতা রয়েছে আমাদের এই ছোট ছোট দলের সেই সক্ষমতা নেই। যে কারণে আন্দোলন বেগবান করতে আমাদের এই জোট।
এই জোট গঠনের চিন্তা কবে থেকে?- জানতে চাইলে সেলিম বলেন, গত ৯ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছ থেকেই আমরা জানতে পেরেছি। তবে এর আগে থেকেই বুঝতে পারছিলাম। বিএনপি নেতাদের পরামর্শেই জোট গঠন করেছি। ১২দলীয় এই জোট তার (শাহাদাত হোসেন সেলিম) মস্তিষ্ক প্রসূত বলেও দাবি করেন তিনি।
এই জোটে ২০ দলের বাকি শরিকরা নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবার সঙ্গে কথা বলেছি। যাদের সঙ্গে একমত হয়েছি তাদের নিয়েই জোট হয়েছে।
যৌথ নেতৃত্বের এই ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক হিসেবে রয়েছেন জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা। তিনি বলেন, যুগপৎ আন্দোলন বেগবান করতে ১২টি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের এককভাবে আন্দোলন করার সেই বাস্তবতা (সক্ষমতা) নেই। যে কারণে জোটবদ্ধ হয়েছি।
১২ দলীয় জোট বা এর শরিকরা শেখ হাসিনাকে সরকারপ্রধান রেখে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে কি না জানতে চাইলে শাহাদাত হোসেন সেলিম এবং সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, আমরা সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছি। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
এদিকে বিলুপ্ত ২০ দলীয় জোটের আরও সাতটি ছোট দল মিলে জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এই জোটের দলগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপি, খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানী, সাইফুদ্দিন মনির ডেমোক্রেটিক লীগ, মাহবুব হোসেন নেতৃত্বাধীন পিপলস লীগ, শাওন সাদেকী নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ এবং আব্দুল করিম নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট।
আগামী সপ্তাহে সাতদলীয় জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে বলে জানিয়েছেন জোটের উদ্যোক্তা দাবিদার ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। তিনি বলেন, বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বারো দলীয় জোট যা করবে, আমাদের সাতদলীয় জোটও তাই করবে।
যুগপৎ আন্দোলন বেগবান করতে ১২টি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আমাদের এককভাবে আন্দোলন করার সেই সক্ষমতা নেই। যে কারণে জোটবদ্ধ হয়েছি।
বারো দলীয় জোটে যাননি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বারো দলীয় জোট গঠনের আগে আমরা তাদের ডেকেছিলাম। তারা আমাদের সঙ্গে আসেনি। আমরাও তাদের জোটে যাইনি।
সম্ভাব্য ৭ দলীয় জোটের আরেক শরিক ন্যাপের আজহারুল ইসলাম বলেন, শিগগির আমরা ৭ দলীয় জোটের ঘোষণা দেবো। তিনি বলেন, বারো দলীয় জোট এবং সাত দলীয় জোট- এটা আমাদের মধ্যে বিভক্তি নয়, যুগপৎ আন্দোলনের কৌশল।
আপনাদের সাংগঠনিক সক্ষমতাজনিত কারণে জোট করেছেন কি না জানতে চাইলে আজহারুল ইসলাম বলেন, সক্ষমতা কম-বেশি যাই থাক, জোট জোটই। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা এখন যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে কাজ করছি। এর বাইরে ভিন্ন কোনো চিন্তা আমাদের নেই।
এটি আওয়ামী লীগের খেলার একটা অংশ। এর মাধ্যমে বিএনপি ও নামসর্বস্ব মিত্রদলগুলোকে নিঃসঙ্গ করা হয়েছে। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নামসর্বস্ব এসব দল জোট করেছে।
তিনি আরও বলেন, বারো দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। সাত দলীয় আরেকটি জোট আসছে। জোট বা জোটের বাইরে হোক, ৩৩টি দল আমাদের সঙ্গে আছে।
এদিকে, গত ৮ আগস্ট জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন- এই ৭টি সমমনা দল নিয়ে গঠিত হয় ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। এই জোটে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য রয়েছে। এই জোটের পক্ষ থেকেও বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে সমর্থন জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকারবিরোধী যে কোনো দল ও জোট এই যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হতে পারে, কোনো বাধা নেই। আমরা মনে করি, নতুন করে কিছু জোট এই আন্দোলনে যুক্ত হলে আন্দোলন আরও বেগবান হবে।