শীতে রাশিয়া-ইউক্রেন দুপক্ষই বিপদে ॥ বরফ গলা জল বুটে ঢুকে পা পচছে সেনাদের। তুষার কাদায় আটকে যাচ্ছে ট্যাঙ্ক

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কনকনে ঠান্ডা, হাড় কাঁপানো বাতাস-শীত এলেই উদয় হওয়া কথা-কলমের এ শৌখিন উপমাগুলো সবই সেখানে অসহায়। হিমাঙ্কেরও (যে শূন্য তাপমাত্রায় বরফ হয়ে যায় সব তরল) অনেক তলে নেমে যায় ‘রুটির ঝুড়ির’ দিন-রাত।
পলকে বরফ হয়ে যায় নিঃশ্বাসের বাতাস। রক্ত জমা শীত শাসনের এই কালবেলাতেই এখন রণক্ষেত্রে ইউক্রেন-রাশিয়া। এক পক্ষ লড়ছে ভূখ- দখলে, অন্য পক্ষ পিঠ বাঁচাতে। ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া টানা ১০ মাসের এ যুদ্ধে এবার বিপদে পড়েছে দুপক্ষই।
কেউ একটু কম, কেউ খানিকটা বেশি। পশ্চিমা গণমাধ্যম বলছে-ইউক্রেনে এখন হিম শীতল ঠান্ডা। নভেম্বরের মাঝের দিনগুলো থেকেই শীত জেঁকে বসেছে দেশটিতে। ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই শুরু হয়েছে তীব্র দুঃশাসন। তুষার বৃষ্টিতে কয়েক পা পরপরই কাদা জমে গেছে রাস্তায়। আটকে যাচ্ছে যুদ্ধের ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, সেনাদের রসদবহর। বিশেষ করে রুশ সেনাদের বহর। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে পরিখায় থাকা সেনারা। তুষার-বরফে ঢেকে যাচ্ছে পরিখার ভিত। কাদা কাদা হয়ে যাচ্ছে পরিখার মাটি। ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে বরফ গলা জল। সে পানি বুটে ঢুকে পচন ধরছে পায়ে। পাথর হওয়া শক্ত-ঠান্ডা মাটিতে নতুন পরিখা খনন হয়ে পড়েছে আরও দুরূহ। ‘উইন্টার ওয়ার’ আখ্যা পাওয়া এ শীতযুদ্ধ মোকাবিলা করাই যেন এখন সৈন্যদের নতুন চ্যালেঞ্জ। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় সৈন্যদের করুণ পরিস্থিতি, যান্ত্রিক দুর্দশা, মাটি-কাদায় যানবাহন ও যোগাযোগের কারণে যুদ্ধকৌশল ব্যাহত হওয়া এখন নতুন সমস্যার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। তুষার ইতোমধ্যেই উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব ইউক্রেনের বিভিন্ন অংশকে চাদরের মতো আবৃত করে ফেলেছে। সেখানে ডনবাসের অবস্থান। এমনকি দেশটির বেশির ভাগ অংশে তাপমাত্রা এখন হিমাঙ্কের নিচে। অনেকেই হিসাবের খাতা খুলে বসেছেন-ঠান্ডায় অধিক লাভবান হবে কারা? ঠান্ডায় কি যুদ্ধও জমে যাবে? নাকি বসন্তের আগেই (মার্চ-মে) থেমে যাবে মৃত্যুর দামামা? অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনা জেনারেল বেন হজেস বলেন, ‘শুধু ঠান্ডা আর ভেজা হচ্ছে আবহাওয়া। কিন্তু আবহাওয়া আবহাওয়াই। প্রযুক্তি দিয়েও আবহাওয়ার পরিবর্তন অসম্ভব।’ তবে ইউক্রেনীয়দের তুলনায় রাশিয়ানরা বেশি ভুক্তভোগী হবে বলে মনে করছেন তিনি। এর কারণ হিসাবে দায়ী করছেন রাশিয়ার সদ্য গঠিত সৈন্যদের, যারা এখনো সুসজ্জিত নয়। তিনি রাশিয়ান সৈন্যদের নেতৃত্বের ঘাটতি আছে বলেও মনে করছেন। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মুখপাত্র সেরহি চেরেভাতি এই সপ্তাহে বলেন, ঠান্ডায় কাদা জমাট বাঁধলে ট্যাঙ্ক এবং ভারী ট্র্যাক চলাচল করতে সক্ষম হবে। রাশিয়ার নতুন ইউনিট টেলিগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ তোলেন। তারা দাবি করেন নিজেদেরই সরাঞ্জম কিনতে হচ্ছে। তারা গরম করার জন্য চুলাসহ নানা ধরনের জিনিস কিনছেন। তবে শোনা গেছে, রাশিয়া তার সৈন্যদের জন্য শীতকালীন পোশাক তৈরি করতে উত্তর কোরিয়ার পোশাক কারখানার দিকে ঝুঁকেছে। শীতের আরেক কৌশলগত সমস্যা হলো-ছোট দিনের আলো আর দীর্ঘ রাত। রুশ-ইউক্রেন দুপক্ষই পড়বে এই সমস্যায়। তাপমাত্রা নেমে আসবে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও নিচে। নেই খাদ্য কিংবা রসদ সরঞ্জাম। সবচেয়ে বেশি ভুগবে রুশ সেনারা। বরফে আটকে থাকা রাস্তায় বেঁচে থাকার রসদ সরবরাহ নিয়ে সন্দিহান রুশরা। আর এখানেই আশার আলো দেখছে ইউক্রেনীয়রা। শুধু রাশিয়ায় নয়, বিপদে পড়েছে ইউক্রেনও। শীত আসার আগেই ইউক্রেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে মস্কো। তবে এই হিমায়িত তাপমাত্রা এবং ছোট দিন প্রভাবিত করবে রুশ বাহিনীকেও। স্বল্প আহত সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য কম সময় পাবে। ইউরোপে গ্রীষ্মের দিনের আলো ১৫-১৬ ঘণ্টা থাকে। আর শীতে দিনের আলো গড়ে হয় ৯ ঘণ্টারও কম সময় থাকে। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলে, সীমিত দিনের আলোয় সম্ভবত উভয়পক্ষেই কৌশলগত পরিবর্তন আনবে। আক্রমণের পরিবর্তে আরও প্রতিরক্ষামূলক নেতৃত্ব দেবে বলেও তারা মনে করছে। তবে ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের’ সিনিয়র উপদেষ্টা মার্ক ক্যানসিয়ান বলেছেন, ঠান্ডায় যুদ্ধ থামাবে না কেউই। ক্যানসিয়ান ‘নিউজউইক’কে একটি ইমেইলের মাধ্যমে বলেন, ‘ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যেই ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতরা নিয়মিতভাবে শীতকালীন আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। সৈন্যরা উষ্ণ গ্রামে কেন্দ্রীভূত হয়। দিনের আলোয় লড়াইয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। যদিও ‘নাইট ভিশন গুগলস’ নামক যন্ত্রে ব্যবহার করে সহজেই রাতের যুদ্ধে অংশ নেওয়া যায়। তবে কোনো দেশের সৈন্যরাই ভালোভাবে প্রশিক্ষিত নয়। রাতের অপারেশনের জন্য প্রয়োজন পরে উচ্চ দক্ষতার’।
ক্যানসিয়ান বলে, সম্ভবত শীত এবার ইউক্রেনীয়দের পক্ষে থাকবে। এর কারণ তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো শীতের পোশাকসহ নানান জিনিস সরবরাহ করছে। আমেরিকার ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মাইকেল কিমেগেও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। তিনিও মনে করেন, ইউক্রেন রাশিয়ার চেয়ে ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারে। লড়াই থামবে না, তবে তিনি আশা করে যে এটি ধীর হয়ে যাবে। শীতকাল ইউক্রেনের জন্য আরও জমি পুনরুদ্ধারের সুযোগ নিয়ে আসতে পারে। ইউক্রেনীয় সেনারা কিয়েভের উত্তরে, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণে শহর ও বসতি পুনরুদ্ধার করেছে। পশ্চিমা মিত্রদের থেকে সহায়তা পাচ্ছেন ইউক্রেনীয় মিত্ররা। পাচ্ছেন কামান, গোলাবারুদসহ শীতকালীন নানা সরাঞ্জম। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানায়, তারা ১,৯৫,০০০ শীতের পোশাক পাঠিয়েছে। এদিকে কানাডা জানায়, তারা প্রায় ৫,০০,০০০ শীতকালীন ইউনিফর্ম পাঠিয়েছে। পেন্টাগন গত মাসে জানায়, তারা ২০০টিরও বেশি পাওয়ার জেনারেটর পাঠিয়েছে। এছাড়া তাঁবু, হিটার এবং হাজার হাজার শীত সরঞ্জাম পাঠানোর দাবিও করে। যুদ্ধ-সম্পর্কিত আঘাতের পাশাপাশি, হাইপোথার্মিয়া ও ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন অসুস্থতাও এখন উদ্বেগের বিষয় রাশিয়া-ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে।
ইউক্রেনকে উপনিবেশ বানিয়েছে পশ্চিমারা : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারের খেলায় পশ্চিমারা ইউক্রেনকে একটি উপনিবেশে পরিণত করেছে। পাশাপাশি তারা ইউক্রেনীয়দের কামানের খোরাক ও মানবঢাল হিসাবেও ব্যবহার করছে। শুক্রবার করিগিজস্তানে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) এবং কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটসের (সিআইএস) গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এসব কথা বলেন তিনি। খবর এএফপি, তাস।
দুই সংস্থার শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই পশ্চিমারা নির্লজ্জভাবে ইউক্রেনের সম্পদ লুট করেছে এবং শোষণ করেছে। দনবাসে তারা অব্যাহতভাবে গণহত্যা ও সন্ত্রাসকে সমর্থন করে আসছে। সর্বোপরি দেশটিকে একটি উপনিবেশে পরিণত করেছে। এখন নিষ্ঠুরভাবে তারা ইউক্রেনের জনগণকে কামানের খোরাক হিসাবে ব্যবহার করছে। এ সময় তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাবসানে শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তির প্রয়োজন হবে। আগাম পারমাণবিক হামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, পারমাণবিক হামলার ধারণার পরিবর্তে শত্রুকে নিরস্ত্র করার জন্য প্রচলিত আগাম হামলার সামরিক নীতি প্রবর্তন করে তার সামরিক নীতিমালা সংশোধন করতে পারে। ক্রমবর্ধমান পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়া প্রথমে হামলা চালাবে না বলে সতর্ক করার মাত্র কয়েকদিন পর সাংবাদিকদের পুতিন বলেন, ‘মস্কো প্রচলিত আগাম হামলার সামরিক নীতি বিবেচনা করছে। যেটি ওয়াশিংটন তাদের কথিত ‘প্রি-এমপটি’ হামলা হিসাবে গ্রহণ করে আসছে। মস্কোকে তাদের ‘নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য’ মার্কিন আগাম হামলার ধারণা গ্রহণের বিষয়ে ভাবতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ‘আরও আধুনিক এবং এমনকি আরও কার্যকর’।