ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড ॥ ইসলামী দৃষ্টিকোণ

25

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান  :
কাগজি নোট আবিষ্কারের আগে বিত্তবানদের ধাতবমুদ্রার ওজন বহন ও সংরক্ষণের বিড়ম্বনার ইতিহাস সকলেরই জানা। তারো আগে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ছিল খাদ্যদ্রব্য। যেমন কারো ২ গজ কাপড় দরকার হলে তাকে বাড়ি থেকে ২ মন ধান নিয়ে দোকানী থেকে এর বিনিময়ে কাপড় সংগ্রহ করতে হত। কিন্তু এসব কিছুতেই ইতিহাস বানিয়ে দিয়েছে আধুনিক যুগের কাগজি মুদ্রা। কিন্তু আজকের সহজপ্রিয় মানুষ এই কাগজি টাকার সহজ বোঝাও আর বইতে রাজি নয়। তাই আগের যুগের বিনিময় মাধ্যমগুলোর তুলনায় কাগজি টাকা অনেক হালকা, সহজে বহনযোগ্য ও সুবিধাজনক হলেও এর চেয়ে আরো সহজ কিছু উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলছেই। কারণ টাকার সংখ্যা অনেক বেশি হলে তা স্থানান্তরও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত নিরাপত্তার দিকটি তো রয়েছেই। এসব সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যেই প্রচলন ঘটেছে ইলেক্ট্রিক মানি তথা ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, প্রিপেইড কার্ড ও এটিএম কার্ড জাতীয় বৈদ্যুতিক মুদ্রার। আজকের আলোচনায় এ সকল কার্ড ব্যবহারের ইসলামের আলোকে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
ক্রেডিট কার্ড : বড় বড় তিনটি আন্তর্জাতিক কোম্পানী ভিসা, মাষ্টার ও আমেরিকান এক্সপ্রেস, ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর লাইসেন্স প্রদান করে থাকে। তাদের লাইসেন্স নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও অনেকগুলো ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড চালু করেছে।
ক্রেডিট কার্ড মূলত বাকিতে কেনাকাটা করা এবং প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ ধার নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত একজন ব্যক্তির আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে এ কার্ড সরবরাহ করে থাকে। এ কারণে একেকজনের ক্ষেত্রে ক্রেডিট লিমিট হয়ে থাকে ভিন্ন ভিন্ন অংকের। কার্ডহোল্ডার তাকে দেওয়া লিমিট অনুযায়ী বাকিতে নির্ধারিত অংকের কেনাকাটা করতে পারে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে সে টাকা ব্যাংককে পরিশোধ করার সুযোগ থাকে। এই মেয়াদ সাধারণত ১৫ দিন থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। শরীয়তের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের সুবিধার্থে নিম্নে ক্রেডিট কার্ডের কিছু নিয়ম উল্লেখ করা হল।
ক্রেডিট লিমিট : এই কার্ড হোল্ডারের নাম ইস্যুকারী ব্যাংক একটি একাউন্ট খুলে থাকে; যাকে বলা হয় কার্ড একাউন্ট। এই একাউন্টে ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাকে একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয। যেমন ৫০ হাজার, এক লক্ষ ইত্যাদি। কার্ডধারী ব্যক্তি এই কার্ড দেখিয়ে ওই পরিমাণ টাকার পণ্য ক্রয় করতে পারে এবং ইচ্ছা করলে ওই নির্ধারিত একাউন্টের ৫০% টাকা নগদও উত্তোলন করতে পারে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঠিক করা ওই একাউন্টকে বলা হয় ক্রেডিট লিমিট।
পণ্য ও সেবা ক্রয় : ক্রেডিট কার্ড দ্বারা কেবল ওই সকল দোকান বা মার্কেট থেকেই কেনাকাটা করা যায় যাদের সাথে কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংকের চুক্তি থাকে। উন্নত বিশ্বে অধিকাংশ বিপনী ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে এই কার্ড ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও আমাদের দেশে এখনো তা ব্যবহারের পরিধি উন্নত কিছু দোকান-মার্কেট, হোটেল- রেস্তোরা ও এয়ারলাইনের মধ্যেই সীমিত রয়েছে। তবে ক্রমান্বয়ে ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংক, এর ব্যবহারকারী ও ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দোকানী থেকে ব্যাংকের ফি গ্রহণ : কার্ডহোল্ডার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা খরিদের পর ইস্যুকারী ব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারকৃত অংকের টাকা দুই-তিন দিনের মধ্যেই পরিশোধ করে থাকে। তবে এ সকল প্রতিষ্ঠান থেকে ইস্যুকারী ব্যাংক নির্ধারিত হারে ফি নিয়ে থাকে; যা সাধারণত ব্যবহারকৃত টাকার ১ থেকে ৩ শতাংশ হয়ে থাকে।
দোকানী কর্তৃক কার্ডহোল্ডার থেকে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ : সাধারণত ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের জন্য কার্ড হোল্ডারকে অতিরিক্ত অর্থপ্রদান করতে হয় না; বরং সাধারণ বাজার মূল্যেই সে কেনা-কাটা করতে পারে। কারণ কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংককে দোকানী কর্তৃক কমিশন প্রদান করা লাগলেও যে দোকানে এ সুবিধা থাকে সেখানে বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যায়। এবং গড় হিসেবে এটি লাভজনক হয়ে থাকে। তবে কোন কোন ছোট দোকানদার অথবা খুবই স্বল্প লাভ করে থাকে (যেমন১-৩%) এমন প্রতিষ্ঠানকার্ডে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৩% চার্জ করে থাকে। তাদের দাবী হচ্ছে, ব্যাংক তাদের থেকে যে ৩% কমিশন নিয়ে থাকে সেটিই তারা গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত নিচ্ছে।
বিল পরিশোধ : মাসের ১টি নির্ধারিত তারিখে ব্যাংক তার কার্ড মেম্বার বরাবরে বিল প্রেরণ করে থাকে। বিল তৈরীর আগ পর্যন্ত যত টাকার কেনাকাটা করা হয়েছে বা যত টাকা খরচ করা হয়েছে তার পুরো হিসাব এতে থাকে। প্রতিবেদন আকারে তৈরী ওই বিলে আরো উল্লেখ থাকে কত তারিখের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে হবে। গত মাসের বিল-তারিখের পরে কোন টাকা পরিশোধ করে থাকলে তার বিবরণ এবং আরো প্রয়োজনীয় তথ্য।
চার্জ : ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী সকল গ্রাহককে মূলত ১টি চার্জই পরিশোধ করতে হয়। তা হল বার্ষিক ফি। তবে কোন কোন সময় এ ফি’র ক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে। আর বার্ষিক ফি’র সাথে আমাদের দেশে ১৫% ভ্যাটও যোগ হয়।
এছাড়া কার্ড ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে আরো কিছু চার্জওব্যাংক কর্তৃক কার্ড মেম্বার থেকে নেওয়া হয়ে থাকে। যেমন- নির্ধারিত তারিখে (মিনিমাম ডিও প্রদানের তারিখ) বিল না দিলে নির্ধারিত অংকের জরিমানা।
ফাইনান্সিয়াল চার্জ : প্রতি মাসের ক্রেডিটকার্ড বিল যদি নির্ধারিত দিনের মধ্যে পুরো জমা করে দেওয়া হয় তবে এ জন্য কোন অতিরিক্ত চার্জ ব্যাংকে প্রদান করতে হয় না। কিন্তু যদি আংশিক বিল প্রদান করা হয় (ব্যাংক থেকে এ ধরনের সুযোগ গ্রাহককে দেওয়া হয়ে থাকে) তবে নির্ধারিত দিনের পর যে টাকা বকেয়া থাকবে তার উপর ব্যাংক মাসিক ভিত্তিতে ২/৩% ফাইনান্সিয়াল চার্জ এর নামে কার্ডহোল্ডার থেকে নিয়ে থাকে।
ক্যাশ এ্যাডভান্স : কার্ড ব্যবহারকারী তার ক্রেডিট লিমিটের ৫০% টাকা ব্যাংকের যে কোন শাখা অথবা এটিএম বুথ থেকে নগদে উত্তোলন করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ওই টাকা পরিশোধের তারিখের আগ পর্যন্ত সময়ের জন্য ২-৩% সুদ আদায় করতে হয়।
শরঈ দৃষ্টিকোণ : ক্রেডিট কার্ডের বিষয়টি নতুন মাসআলা হওয়ার এ সংক্রান্ত শরীয়তের হুকুম কী হতে পারে তা নির্ণয়ের জন্য বর্তমান যুগের ফকীহগণ অনেক আগে থেকেই একক ও সম্মিলিত গবেষণা করেছেন। ওআইসি ফিকহ একাডেমীতে এ বিষয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানে বেশ কিছু প্রবন্ধ পেশ করা হয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনার পর ফয়সালাও করা হয়েছে। এছাড়া আরবের ও আমাদের এ অঞ্চলের আরো কয়েকজন ফকীহ এ বিষয়ে প্রবন্ধ বা পুস্তিকা লিখেছেন। তাদের মতামতের সারকথা হল, কিছু শর্ত সাপেক্ষে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা জায়েয। মাসআলার দিক থেকে ক্রেডিট কার্ডের যে সকল বিষয় আলোচনায় আসে সেগুলো হল, ক্রেডিট লিমিট, দোকানী থেকে ব্যাংকের কমিশন গ্রহণ, দোকানী কর্তৃক (ক্ষেত্র বিশেষে) কার্ডহোল্ডার থেকে অতিরিক্ত চার্জ গ্রহণ, ফাইনান্সিয়াল চার্জ, রিওয়ার্ড ও ক্যাশব্যাক ইত্যাদি। এখানে সংক্ষেপে সেগুলোর হুকুম তুলে ধরা হল।
ব্যাংক ও কার্ডহোল্ডারের মাঝে লেনদেন : কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংক কার্ডমেম্বার থেকে যে সকল চার্জ নিয়ে থাকে তার মধ্যে একটি হল ‘বার্ষিক ফি’ একথা সুস্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে শরীয়তের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এ কারণ ব্যাংক কার্ডধারী ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে যে সকল সার্ভিস প্রদান করে থাকে তার বিনিময় হিসেবেই এ ফি নিয়ে থাকে।
কার্ড ব্যবহারকারী থেকে ব্যাংক ফাইনান্সিয়াল চার্জ বা ইন্টারেস্ট নামে যে অর্থ নিয়ে থাকে তা ওই সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা নির্ধারিত দিনে পুরো টাকা আদায় করে না। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, ওই টাকা ব্যাংক কর্তৃক বিক্রেতাকে পরিশোধ করা টাকার সুদ হিসাবে। অতএব এ টাকা দেওয়া নেওয়া কোনটাই জায়েয নয়। অর্থাৎ ক্রেডিট কার্ডের বিল আদায়ে এত বিলম্ব করা যাবে না, যে কারণে এর উপর ফাইনান্সিয়াল চার্জ তথা সুদ আরোপিত হয়।
ক্যাশ এ্যাডভান্স : আগেই বলা হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা কেনাকাটার পাশাপাশি এ কার্ড দ্বারা নগদ টাকাও উত্তোলন করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তাকে ডেইলি এ্যাভারেজ ভিত্তিতে ২-২.৫% সুদ আদায় করতে হয়। সুতরাং ক্রেডিট কার্ড দ্বারা নগদ টাকা গ্রহণ করা যে হারাম তা বলাই বাহুল্য।
দোকানী ও কার্ডহোল্ডার : আগেই বলা হয়েছে, যে সকল বিপণী বিতান অথবা বিভিন্ন সেবা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে ক্রেডিটকার্ড গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে তাদের অধিকাংশই নগদ বিক্রয় এবং কার্ডের মাধ্যমে বিক্রি একই মূলে করে থাকে। তবে কোন কোন প্রতিষ্ঠান কার্ডের বিক্রির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ২-৩% চার্জ করে থাকে। এ অতিরিক্ত অংশের ব্যাপারে বর্তমান সময়ের ফকীহগণ গবেষণা করে একাধিক মত প্রদান করেছেন। তাঁদের অধিকাংশের মত হল অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার কারণে ওই বেচাকেনা নাজায়েয হবে না এবং এটি সুদের আওতায়ও পড়বে না। কারণ এখানে কার্ডহোল্ডার তার কাছ থেকে কোন ঋণ নেয়নি যার সুদ দোকানী তার কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারে। আসলে এ অতিরিক্ত টাকা পণ্যমূল্যেরই অংশ। যেমনিভাবে বাকিতে কোন জিনিস কিনতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে মূল্য বাড়িয়ে নেওয়া হয়, তেমনি এ ক্ষেত্রেও ক্রেডিটে খরিদের কারণে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে। সুতরাং এটি নাজায়েয নয়। অবশ্য কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও হয়ে থাকে। অর্থাৎ ক্রেডিট কার্ডে মূল্য পরিশোধ করলে ৫% বা ১০% বা এর কমবেশি ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। এটি মূলত করা হয় ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির মাধ্যমে, যেন এ উসিলায় কার্ড ব্যবহারকারীরা এ প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি বেশি কেনাকাটা করতে আগ্রহী হয়। শারীয়তের দৃষ্টিতে এ ডিসকাউন্ট প্রদানে কোন আপত্তি নেই।
রিওয়ার্ডস : কোন কোন কার্ড ইস্যুকারী তাদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন ভাবে পুরস্কৃত করে থাকে। কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করা টাকার পরিমাণের ভিত্তিতে সাধারণত এ পুরস্কারগুলো দেওয়া হয়ে থাকে। ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, এটি বিশেষ কোন কার্ডধারী নয়; বরং সকলেই পেয়ে থাকে। এবং কার্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান কার্ডের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য তাদের আয়ের কিছু অংশ কার্ড হোল্ডারদের পুরস্কার প্রদানের খাতে ব্যয় করে থাকে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এতে মাসআলাগত কোন সমস্যা নেই। তবে কার্ড ব্যবহারকারীর উদ্দেশ্য হতে হবে কেনাকাটা, পুরস্কার মুখ্য উদ্দেশ্য থাকা উচিত নয়।
ভ্যাট ও ট্যাক্স : এতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশে শুধু ক্রেডিট কার্ডের বার্ষিক ফি’র উপর ১৫% ভ্যাট নিত সরকার। কিন্তু চলতি অর্থ বছরের বাজেটে ক্রেডিট কার্ডের যে কোন ট্রাঞ্জেকশনের উপর ৩% অগ্রিম ট্যাক্স আদায়ের বিধান করা হয়। এ ধরনের ভ্যাট ও ট্যাক্স আরোপ শরীয়তের দৃষ্টিতে অনধিকার চর্চা ও জুলুমের অন্তর্ভূক্ত হলেও এর কারণে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা নাজায়েয হবে না।
ক্যাশব্যাক : সম্ভবত নব আরোপিত ট্যাক্সের প্রভাবে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমে যাওয়ায় কোন কোন ব্যাংক তাদের ক্রেডিট ব্যবহারকারীদের জন্য ঘোষণা করেছে ক্যাশ ব্যাক প্রোগ্রাম। কার্ডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করলে কিছু শর্ত সাপেক্ষে তারা ট্রাঞ্জেকশন এমাউন্টের ১-৫% পর্যন্ত কার্ড হোল্ডারের একাউন্টে জমা দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। তাদের এ সংক্রান্ত প্রচারপত্র ও শর্তাবলী দেখে বুঝা যাচ্ছে, এটিও এক ধরনের শর্তযুক্ত পুরস্কার, যার মাধ্যমে কার্ডের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সুতরাং এর হুকুম হবে উপরোক্ত রিওয়ার্ডস প্রোগ্রামের মত।
দোকানী থেকে ব্যাংকের কমিশন গ্রহণ : হোটেল, রেস্তোরা, দোকান ও মার্কেটসহ যে সকল প্রতিষ্ঠানে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে টাকা পরিশোধের সুযোগ রয়েছে তাদের থেকে কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংক একটি নির্ধারিত পরিমাণে (সাধারণত ১-৩%) চার্জ নিয়ে থাকে। কার্ড দ্বারা পরিশোধিত এমাউন্টের উপর এ চার্জ নির্ধারিত হয়ে থাকে। উক্ত টাকার হুকুম শরীয়তের দৃষ্টিতে কী হবে এ নিয়ে গবেষক ফকীহ আলেমদের ২টি ভিন্নমত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি ব্যাংক কর্তৃক দোকানীকে অগ্রিম পরিশোধ করে দেওয়া টাকার (যা কার্ড হোল্ডার থেকে ব্যাংক নির্ধারিত মেয়াদের পর নিবে) উপর একটি চার্জ, যা সুদের নামান্তর। সুতরাং এ টাকা গ্রহণ করা জায়েয নয়। পক্ষান্তরে অন্য ফকীহদের মতে এটি সুদের আওতায় পড়ে না। কারণ এখানে দোকানী ব্যাংক থেকে কোন ঋণ নিচ্ছে না; যার জন্য সে সুদ প্রদান করবে। এ শ্রেণীর আলেমদের মতে এটি হল ব্যাংকের পক্ষ থেকে দোকানীকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করা এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় মেশিনারী সরবরাহের চার্জ স্বরূপ। সুতরাং এটি নাজায়েয নয়। অবশ্য এ মাসআলার হুকুম যাই হোক তা কার্ড হোল্ডার ও কার্ড ইস্যুয়ার এর মাঝের কারবারের হুকুমে প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে হয়।
সার সংক্ষেপ : ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত উপরের আলোচনার সারকথা হল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে বর্তমান যুগের ফকীদের উত্থাপিত প্রবন্ধ ও সিদ্ধান্তবলীর আলোকে এ কার্ড ব্যবহার করা কিছু শর্ত সাপেক্ষে জায়েয। শর্তগুলো হল-
১। ক্রেডিট কার্ডের সকল বিল ‘মিনিমাম ডিও’ তারিখের মধ্যে অবশ্যই পরিশোধ করে দিতে হবে। কোন টাকা বাকি রাখা যাবে না।
২। কার্ডের মাধ্যমে কোন ক্যাশ এ্যাডভান্স নেওয়া যাবে না। কারণ নগদ টাকা উত্তোলনের অর্থই হল ব্যাংক কর্তৃক সুদ আরোপিত হওয়া।
৩। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কখনো কোনভাবেই এমন কারবারে অংশগ্রহণ করা যাবে না, যা সুদের অন্তর্ভূক্ত। যদি কার্ড ইস্যুকারী কর্তৃক নতুন কোন সুযোগ সুবিধার কথা ঘোষিত হয়- যা মাসআলার দিক থেকে সন্দেহজনক, তবে অবশ্যই সে ব্যাপারে বিজ্ঞ কোন মুফতী থেকে মাসআলা জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে।
উপরোক্ত শর্তগুলো পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ক্রেডিট কার্ড নেওয়া ও তা ব্যবহার করার অবকাশ শরীয়তে রয়েছে। ডেবিট কার্ড/ এটিএম কার্ড দেখতে ক্রেডিট কার্ডের মতই আরেকটি ইলেকট্রিক মানি হল ডেবিট কার্ড তথা এটিএম কার্ড। এ কার্ডের সূচনা এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) থেকে। বর্তমানে এটিএম কার্ডকেই কোন কোন ব্যাংক ডেবিট কার্ডে উন্নীত করে এর দ্বারা কেনাকাটার সুযোগ করে দিয়েছে। এটিএম কার্ড সম্পর্কে অনেকেরই হয়ত ধারণা রয়েছে। কারণ আমাদের দেশে এ প্রযুক্তি এসেছে কম সময় হয়নি। ব্যাংকে একাউন্টারী ব্যক্তি এটিএম কার্ড দিয়ে বছরের যে কোন দিন যে কোন সময় (৩৬৫ দিনের ২৪ ঘন্টা) নির্ধারিত বুথ থেকে নগদ টাকা উত্তোলন করতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে তার একাউন্টে ওই পরিমাণ টাকা থাকা আবশ্যক। আবার এ কার্ড দ্বারা বর্তমানে অনেক মার্কেট, দোকান বা সেবা প্রতিষ্ঠানের বিলও পরিশোধ করা যায়।
সুতরাং ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ডের সুযোগ-সুবিধা প্রায় কাছাকাছি হলেও এ দু’টির মাঝে মৌলিক পার্থক্য হল-প্রথমটির দ্বারা আগে খরচ করে পরে টাকা পরিশোধ করতে হয়। পক্ষান্তরে ডেবিট কার্ডের সুবিধা তখনি পাওয়া যাবে যদি কার্ডধারীর একাউন্টে আগে থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা জমা থাকে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ডেবিট কার্ডের মাসআলা সহজ এবং এটি ব্যবহার করা জায়েয। আর এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো যে বার্ষিক ফি নির্ধারণ করে তাও নাজায়েয নয়। অবশ্য ফি হওয়া দরকার যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে। দেশীয় কোন কোন ব্যাংক কিছুদিন আগেও এটিএম কার্ডের সীমিত সুযোগ দিয়ে ১,৫০০/- করে বার্ষিক ফি নিয়েছে; যা পরিষ্কার জুলুমের অন্তর্ভূক্ত। বর্তমানেও ব্যাংকগুলো ৫০০/ ৬০০ করে এ ফি নিয়ে থাকে। বাস্তবতার বিচারে তা হওয়া দরকার আরো কম।
প্রকাশ থেকে যে, ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত উপরোক্ত আলোচনা পত্রিকার স্থানের বিবেচনায় সংক্ষিপ্তভাবে করা হয়েছে। তাই কিছু কিছু বিষয়ে এখানে আলোকপাত করা হয়নি। যেমন ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ডে কোন কোন ব্যাংকের ‘লিও’ বা ‘এফবিআর’ এর শর্ত আরোপের মাসআলা এবং এ ধরনের আরো দু’একটি বিষয়। যাদের বিষয়টি প্রয়োজন তারা নির্ভরযোগ্য দারুল ইফতা থেকে জেনে নিবেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।