কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আবাদি জমি রক্ষায় পরিকল্পিত শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে যুব ও নারীদের এ খাতে অবদান রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যত্রতত্র কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যাবে না। আবাদি জমি ও তিন ফসলি জমির কোনো ক্ষতি করা যাবে না। শিল্পায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনব। শিল্প মালিকদের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যারা এখানে শিল্পপতি আছেন আমি অনুরোধ করব যার যার নিজের ইন্ডাস্ট্রি চালিয়ে অন্তত নিজের দেশের মানুষের চাহিদাটা পূরণ করার প্রচেষ্টাটা নেবেন। কারণ আপনাদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে। এখন আর হাওয়া ভবন নাই যে আপনাদের কোন কাজ পেতে হলে হাওয়া ভবনের পাওনা মেটাতে হয় বা এখানে ওখানে ছোটাছুটি করতে হয়। আমরা একটা নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে দেশকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। রবিবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) ৫০টি শিল্প ইউনিট, প্রকল্প ও সুযোগ-সুবিধা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগদান করে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও আমি ৫০টি শিল্প ইউনিট ও অবকাঠামোর উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পেরে আমি খুবই আনন্দ বোধ করছি।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান এমপি, চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান, চট্টগ্রামের বিএসএমএসএন প্রান্তে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কর্মকান্ডের ওপর একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। ৫০টি শিল্প সুবিধার মধ্যে চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে (বিএসএমএসএন) চারটি কারখানা এবং বেসরকারিভাবে পরিচালিত বিভিন্ন ইজেডে আটটি কারখানা খোলা হয়েছে।
প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন একযোগে মোট আটটি ভেন্যু থেকে অনুষ্ঠিত হয়। ভেন্যুগুলো হলো- গণভবন, ঢাকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর (বিএসএমএসএন মিরসরাই, চট্টগ্রাম), শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল (শ্রীহট্ট, মৌলভীবাজার), কর্ণফুলী ড্রাইডক এসইজেড (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম), মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থনৈতিক অঞ্চল (সোনারগাঁও,নারায়ণগঞ্জ), জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল (জামালপুর সদর), সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক (সাবরাং, কক্সবাজার) ও হোসেন্দি অর্থনৈতিক অঞ্চল (গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ)।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছি বলেই ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এটা ধরে রাখতে হবে আর সেজন্য আমাদের ব্যাপকভাবে শিল্পায়নটা দরকার। কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধিসহ আমাদের নতুর নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে এবং জনগণের আর্থসামাজিক উন্নতি করে তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে নিজস্ব বাজার সৃষ্টি হয়।
তিনি বলেন, জাতির পিতা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার সময় বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা এনে দেন এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের মান ও মর্যাদা বিশে^ যেন আরও বৃদ্ধি পায় সে পদক্ষেপ নেয়। তার সরকার সে কারণেই সারাদেশে ১শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে এবং প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই বেশ কয়েকটি ইপিজেড নির্মাণ করে দেয়। উত্তরবঙ্গে প্রথম নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড প্রতিষ্ঠার কথাও উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাদেশে ইতোমধ্যে ইপিজেড করার জন্য ৯৭টি জায়গায় জমি তার সরকার ঠিক করে রেখে দিয়েছে এবং যেখানে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিনিয়োগ আসবে। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক ধাক্কা সারাবিশে^র মতো বাংলাদেশে লাগলেও তাঁর সরকার সেটি সামলে নিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখায় সচেষ্ট রয়েছে। এর ওপর মড়ার উপর খাড়ার ঘা, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং স্যাঙ্কশন, পাল্টা স্যাঙ্কশনের ফলে আমাদের ক্রয় ক্ষমতায় সীমাবন্ধতা নেমে এসেছে।আমদানি পণ্যের দাম যেমন বেড়ে গেছে তেমনি পরিবহন খরচ আরও বেড়ে গেছে। ফলে অনেক দেশ আজকে অর্থনৈতিক মন্দার ঘোষণা দিয়েছে, মন্দায় ভুগছে। শিল্প মালিকদের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন। কাজেই সেই ব্যবসার ক্ষেত্রটা প্রস্তুত করা এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সেটা আমরা করে দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে আমি বলবো আপনারা প্রত্যেকেই দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন, যত বেশি মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন আমরা সরকার তত বেশি আপনাদের সহযোগিতা করব। কিন্তু এমন কিছু করবেন না যেখানে মানুষ কষ্ট পায় বা মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
তিনি বলেন, কৃষিজমি যেমন আমাদের বাঁচাতে হবে তেমনি শিল্পোৎপাদনও করতে হবে সেজন্য যত্রতত্র যেন শিল্প গড়ে না ওঠে সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের অভাবের কারনে বাংলাদেশ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, মিরসরাই শিল্প অঞ্চলে যে সব ফসলি জমি রয়ে গেছে সেগুলোয় ফসল হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, একপাশে ইন্ডাস্ট্রি আরেক পাশে পুরো ধানক্ষেত। আমি ধানক্ষেতে নিজে নেমে সেখানে দেখে এসেছি। কাজেই আমাদের দেশেও সেভাবে হতে পারে। আমরা সেটাই চাই।
শিল্পায়নের জন্য যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে গ্যাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। এমনকি বিদেশ থেকে কেনার চেষ্টা করছি। যাতে গ্যাস সংকটে না পড়তে হয়। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে শিল্পায়নের জন্য জায়গা দিয়ে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। শিল্পায়ন এক এলাকা ভিত্তিক নয়, সারা বাংলাদেশব্যাপী করা হচ্ছে। তবে শিল্পায়ন করতে গিয়ে তিন ফসলের জমি নষ্ট করা যাবে না। যারা জমি দেবে তাদের পরিবারের সদস্যদের কর্মস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি এ সময় অহেতুক চাকরির পেছনে না ছুটে সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যুব সমাজকে উদ্যোক্তা হওয়ার এবং নিজের এবং অপরের জন্য কর্মসংস্থানে এগিয়ে আসায় তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ দ্রুত হয়েছে। ঢাকা থেকে আরও অল্প সময়ের মধ্যে যাতে রেলে চট্টগ্রামে পৌঁছা যায়, সেই জন্য নতুন একটা রেল লাইনের চিন্তা করছি। এটা আমরা কবর। পাশাপাশি মিরেরসরাই থেকে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ এবং চার লেনের রাস্তা ৬ লেন করার ওপরও গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, কক্সবাজারে আমরা আন্তর্জাতিকমানের এয়ারপোর্ট করে দিচ্ছি। চট্টগ্রাম কর্ণফুলী টানেল করে দিচ্ছি। এপারের মানুষ ওপারে যেতে আর অসুবিধা হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার একটানা প্রায় ১৪ বছর সরকার পরিচালনায় আছে বলেই উন্নয়ন আজ দৃশ্যমান হয়েছে এবং এর সুফল জনগণ পাচ্ছেন। বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয় বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার।
এ সময় মালিক পক্ষের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদি শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা আপনারা করে দেন তাহলে শ্রমিকরা ভালো থাকলে তাদের কাছ থেকে অধিক কাজ পাবেন, অধিক উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থাও আমাদের করা আছে।
ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন করে দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগের জন্য আসছে। আমরা একেকটা দেশের জন্য একেকটা খন্ড জমি দিয়ে দিচ্ছি। তারা নিজেদের মতো করে তাদের দেশ থেকে যে সমস্ত কোম্পানি আসবে এটা সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। তাদের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়বে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আমার দেশের যেটা প্রয়োজন সেই চাহিদাও মেটাবে, বিদেশে রপ্তানিও করতে পারবে। শেখ হাসিনা বলেন, এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং এখান থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আমরা নির্ধারণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে ইতোমধ্যে ২৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক উৎপাদন করছে এবং ৬১টি শিল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এ পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া সকল অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প নির্মাণে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।