হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী :
পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে “হে আমার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি (উম্মতদেরকে) বলুন, আমি তোমাদের নিকট এর (রিসালত ও নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের) কোন প্রতিদান বা বিনিময় চাইনা। তবে আমার নিকটজন তথা আহলে বাইতগণের প্রতি তোমরা সদাচরণ করবে।” (সূরা শূরা-২৩)
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন “হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে”। (সূরা আল আহযাব- ৩৩)
হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রাদিয়্ল্লাাহু আনহা বলেন, একদা ভোরবেলা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একখানা কাল বর্ণের পশমী কম্বল শরীর মুবারকে জড়িয়ে বের হলেন। এমন সময় হযরত ইমাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু সেখানে আসলেন, তিনি তাঁকে কম্বলের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। তারপর হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু আসলেন, তাঁকেও ইমাম হাসান’র রাদিয়াল্লাহু আনহু সহিত প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতঃপর হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহু আসলেন তাঁকেও তাতে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। তারপর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আসলেন, তাঁকেও তার ভিতরে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতঃপর নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন শরীফ-এর এই আয়াত শরীফ খানা পড়লেন, “হে আমার আহলে বাইত! আল্লাহ তা’য়ালা আপনাদেরকে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রেখে পবিত্র করার মত পবিত্র করবেন।” (মুসলিম শরীফ)
আহলে বাইত ও আওলাদে রসূলগণের পরিচয়:
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমার বংশ জারী থাকবে আমার মেয়ে হযরত ফাতিমাতুয যাহর’র রাদিয়াল্লাহু আনহার মাধ্যমে। অর্থাৎ জান্নাতের যুবকগণের সাইয়্যিদ (সর্দার) হযরত ইমাম হাসান এবং হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র মাধ্যমে। তাঁদের বংশোদ্ভূত সন্তানগণই সাইয়্যিদ বা আওলাদে রসূল নামে পরিচিত।
আহলে বাইতের ফযীলত:
আহলে বাইতের ফযীলত সম্পর্কে বহু হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে। তন্মধ্যে কতিপয় হাদীছ শরীফ বর্ণনা করা হলো: “হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান সম্পদ রেখে যাচ্ছি। তন্মধ্যে প্রথমটি হল, আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে রয়েছে হিদায়েত ও নূর। অতএব, তোমরা আল্লাহর কিতাবকে খুব মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর এবং দৃঢ়তার সাথে তার বিধি-বিধান মেনে চল। অতঃপর বললেন,আর দ্বিতীয়টি হলো; আমার আহলে বাইত। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বাইত সম্পর্কে আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ নছীহত করছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বাইত সম্পর্কে আল্লাহ পাকের তরফ থেকে বিশেষ নছীহত করছি। তাঁদের ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করছি। তাঁদের ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করছি। “(মুসলিম শরীফ)
“হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, তিনি (বিদায়) হজে¦ আরাফাতের দিন তাঁর “কাসওয়া” নামক উষ্ট্রীর উপর সওয়ার অবস্থায় খুৎবা দান করছেন। আমি শুনেছি, তিনি খুৎবায় বলেছেন, হে লোক সকল! আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তাকে শক্তভাবে ধরে রাখ, তবে কখনও গোমরাহ হবে না। তা হলো আল্লাহ পাকের কিতাব ও আমার ইত্রত বা আহলে বাইত।” (তিরমিযী শরীফ)
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহ পাককে মুহব্বত কর। কেন না, তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহের মাধ্যমে অনুগ্রহ করে থাকেন। আর আমাকে মুহব্বত কর আল্লাহ পাকের মুহব্বতে, আর আমার আহলে বাইতকে মুহব্বত কর আমার মুহব্বতে।” (তিরমিযী শরীফ)
“হযরত আবূ যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি কা’বা শরীফ-এর দরজা ধরে বলেছেন, আমি নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, সাবধান! আমার আহলে বাইত হলো তোমাদের জন্য হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম-এর নৌকার ন্যায়। যে তাতে আরোহন করবে, সে রক্ষা পাবে। আর যে তা হতে পশ্চাতে থাকবে সে ধ্বংস হবে।” (মুসনাদে আহমদ শরীফ)
হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আলাইহুন্না:
“হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নিশ্চয়ই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা, হযরত ইমাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে বলেছেন, যারা তাঁদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করবে,আমি তাদের শত্রু। পক্ষান্তরে যে তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করবো।” (তিরমিযী শরীফ)
“হযরত মিসওয়ার ইবনে মাখরামা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহু আমার (দেহ মুবারকেরই) একটি টুকরা। যে তাঁকে রাগান্বিত করবে, সে আমাকেই রাগান্বিত করলো।” (বুখারী, মুসলিম)
“হাসান ও হুসাইন জান্নাতী নাম সমূহের দু’টি নাম। ‘এর আগে আরবের জাহিলিয়াত যুগে এ দু’নামের প্রচলন ছিল না।”
“হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হযরত ইমাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু দু’জনই জান্নাতী যুবকগণের সাইয়্যিদ।” (তিরমিযী শরীফ)
“হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁরা দু’জনেই দুনিয়াতে আমার দু’টি ফুলস্বরূপ।” (তিরমিযী শরীফ)
“হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু হলেন (চেহারা-আকৃতি-অবয়বে) মাথা মুবারক হতে বক্ষ মুবারক পযর্ন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সদৃশ। আর হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু হলেন বক্ষ মুবারক হতে নীচ পযর্ন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সদৃশ।” (তিরমিযী শরীফ)
“হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন অবস্থায় বাইরে তাশরীফ আনলেন যে,উনার এক কাঁধের উপর হযরত ইমাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু কে এবং অন্য কাঁধের উপর হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু কে বসিয়ে ছিলেন। এভাবে আমাদের সামনে তাশরীফ আনলেন এবং ইরশাদ করলেন-‘যে তাঁদের দু’জনকে মুহব্বত করলো,সে আমাকে মুহব্বত করলো। আর যে তাঁদের সাথে দুশমনী করলো,সে আমার সাথে দুশমনী করলো।”
“হযরত বারা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি যে,তিনি হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু কে নিজের কাঁধের উপর রেখে বলছেন, হে আল্লাহ পাক! আমি তাঁকে মুহব্বত করি,আপনিও তাঁকে মুহব্বত করুন।” (বুখারী, মুসলিম)
“হযরত ইয়া’লা ইবনে মুররাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আমার থেকে আর আমি হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে। যে ব্যক্তি হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে মুহব্বত করবে আল্লাহ পাক তাকে মুহব্বত করবেন।” (তিরমিযী শরীফ)
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাহাদাত:
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বিলাদত শরীফ-এর কিছু দিন পরই উনার শাহাদাতের কথা সবার কাছে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে। “হযরত উম্মুল ফজল রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি একদিন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র খিদমতে উপস্থিত হয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে উনার কোলে দিলাম। এরপর আমি দেখলাম, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র চোখ মুবারক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, এর কারণ কী ? ইরশাদ করলেন, আমার কাছে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে এ খবর দিয়ে গেলেন ‘নিশ্চয়ই আমার উম্মত আমার এ শিশুকে শহীদ করবে।’ হযরত উম্মুল ফজল রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! এ শিশুকে শহীদ করবে ? হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হ্যাঁ, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম শাহাদাত স্থলের লাল মাটিও এনেছেন। “আমার ছেলে (দৌহিত্র) হযরত ইমাম হুসাইনকে ফোরাত নদীর তীরে যে জায়গায় শহীদ করা হবে, সে জায়গার নাম কারবালা।” (সাওয়ায়িকে মুর্হারেকাহ)
আর সত্যি সত্যিই হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র ভবিষ্যদ্বাণী মুতাবিক হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন।
কুরআন ও সুন্নাহর উপরোক্ত বর্ণনা থেকে আহলে বাইত রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ যে সীমাহীন ফযীলত, মর্তবা, বুযূর্গী ও সম্মানের অধিকারী তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে এটাও ফুটে উঠেছে যে, আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি’র সন্তুষ্টি ও রেযামন্দি হাছিল করতে হলে আহলে বাইতগণের প্রতি সুধারণা পোষণ করা, তাঁদেরকে মুহব্বত করা এবং ইজ্জত-সম্মান করা। তাঁদের মুহব্বত সকলেরই নাজাতের কারণ। যে যতটুকু মুহব্বত করবে, সে ততটুকুই সম্মান লাভ করবে।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট।