ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিকল্প শ্রমবাজার হতে পারে দক্ষিণ কোরিয়া

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অর্জুন চৌধুরীর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে। দক্ষিণ কোরিয়ায় অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে নিজের এবং পরিবারের ভাগ্য বদলেছেন তিনি। অন্য দেশের তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ায় বেতন ও জীবনমান অনেক উন্নত হওয়ায় অভিবাসী শ্রমিকদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে দেশটি। জেলার অন্য থানার মানুষ এখন বিদেশ যেতে চাইলে প্রথমেই দক্ষিণ কোরিয়ার কথাই ভাবছেন। অর্জুনের মতো হাজারো তরুণ এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় যেতে নিয়মিত লেখাপড়া করছেন।
কোরিয়াতে জনশক্তি রপ্তানি হয়ে থাকে দুই দেশের সরকারের মধ্যেকার এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম বা ইপিএসের মাধ্যমে। যার কারণে শ্রমিকদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। সরকার নজর দিলে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিকল্প শ্রমবাজার হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া ভাল গন্তব্য হতে পারে বাংলাদেশীদের জন্য।
কোরিয়াতে একজন শ্রমিকের প্রতি মাসের বেতন এক লাখ ২০ হাজার টাকা। আর ওভারটাইম করলে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয় মাসে। এই দেশে কাজ করলে অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক ভালো পরিস্থিতিতে থাকা যায়। দেশে রেমিটেন্স পাঠানো যায় বলেন অর্জুন। তার মতো আরও শত শত বাংলাদেশী এখন অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া যেতে উন্মুখ।
কোরিয়া যাওয়ার জন্য প্রথমেই যেটি প্রয়োজন সেটি হলো কোরিয়ান ভাষার ওপর দখল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কোরিয়ান ভাষা কোর্সে ভর্তি হয়ে ভাষা শিখছেন তারা। রাজধানীতে কোরিয়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছাড়াও অন্যান্য কেন্দ্রেও আছে ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা। মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যখন বাংলাদেশীরা নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে, তখন সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া এক আদর্শ শ্রমবাজার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশের সামনে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়া এখন অনেকের পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠছে। সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের কর্মীরা যেসব দেশে কাজ করছেন তার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া সেরা। অভিবাসী কর্মীর সংখ্যার দিকটা বিবেচনা না করে জীবনমান ও বেতনের কথা বিবেচনা করলে দক্ষিণ কোরিয়া এখন পছন্দের শীর্ষে রয়েছে।
কারণ যারা যাচ্ছে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কোম্পানি সিলেক্ট করে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের বেতন লাখ টাকার ওপরে। ওভার টাইমে যে টাকা পান সেটা দিয়ে বেতন আরও বেশি হয়, বলছিলেন তিনি। দক্ষিণ কোরিয়ায় দক্ষ কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেরকম সাফল্য পেয়েছে এবং সেখানে যাওয়া কর্মীরাও যেরকম খুশি-সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এখন এই বাজারের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।
চলতি মাসের শুরুর দিকে আড়াইশ’ বাংলাদেশী দক্ষ কর্মী হিসেবে কাজ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। আর এরা সবাই সেখানে গেছেন দুই দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তির অধীনে বোয়েসেলের তত্ত্বাবধানে। কারণ বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী পাঠানো হয় দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা-চুক্তি অনুযায়ী। যে কর্মসূচীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেখানে কর্মী পাঠায় তার নাম এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম বা ইপিএস। বাংলাদেশের একমাত্র সরকারী জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেল ২০০৮ সাল থেকে ইপিএস কর্মসূচীর আওতায় স্বল্প ব্যয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী পাঠাচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ইপিএস-এর আওতায় নির্ধারিত ১৬টি দেশ থেকে কোরীয় ভাষা দক্ষতা ও স্কিল টেস্টের মাধ্যমে অদক্ষ কর্মীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। তবে কোভিড মহামারীর কারণে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের নবেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত সব কটি দেশ থেকে কর্মীদের কোরিয়ায় যাওয়া বন্ধ রেখেছিল।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিড পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতির পর নির্ধারিত কোভিড বিধি অনুসরণ করে গত বছরের ডিসেম্বর হতে আবার কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে। গত ডিসেম্বরে প্রথম যে দলটি দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো হয় সেখানে ছিল ১১১ জন কর্মী। আর এ বছরের প্রথম ধাপের জন্য বাংলাদেশকে ১৯৪১ জন কর্মী পাঠানোর কোটা দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু সেই কোটা পূরণের পর আরও অতিরিক্ত তিন হাজার কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। ফলে ইপিএস কর্মসূচীর আওতায় এ বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে একটা রেকর্ড করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার যোগ্যতা : কেউ যদি দক্ষিণ কোরিয়ায় কাজের উদ্দেশ্যে যেতে চান তাহলে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড বা বোয়েসেলের ওয়েবসাইটে নাম নিবন্ধন করতে হয়। এরপর লটারির মাধ্যমে আগ্রহীদের মধ্য থেকে কর্মী বাছাই করা হয়। যারা লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত হন, তাদের কোরিয়ান ভাষা শিখতে হয়।
সাধারণত প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল মাসে নিবন্ধন শুরু হয়। লটারিতে নাম উঠলে ভাষা শেখার জন্য গড়ে প্রায় দুই মাস সময় পান প্রার্থীরা। এরপর ভাষা পরীক্ষায় বসতে হয়। দুশ’ নম্বরের এই পরীক্ষার মধ্যে রিডিং টেস্টের জন্য থাকে একশ’ নম্বর, আর লিসেনিং টেস্টের জন্য একশ’ নম্বর। ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কাজের দক্ষতার পরীক্ষা বা স্কিল টেস্ট নেওয়া হয়।
কোন খাতে কর্মী নেওয়া হয় : কেউ দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী হিসেবে যাওয়ার জন্য সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তাদের চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা বোয়েসেলের নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার কোন ক্ষুদ্র বা মাঝারি প্রতিষ্ঠান যখন তাদের প্রতিষ্ঠানে বাইরে থেকে কর্মী এনে নিয়োগ দিতে চান, তখন তাদের সেদেশের শ্রম এবং কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। মন্ত্রণালয় তখন চাহিদা যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়। বার্ষিক কোটা অনুযায়ী চাহিদার ভিত্তিতে তখন দৈবচয়ন পদ্ধতিতে জব রোস্টার থেকে লেবার কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার চাকরিদাতা হলো সেখানকার ছোট ছোট বেসরকারি কোম্পানি। কোন কোম্পানি কোন কর্মীকে জব অফার প্রদান করলেই কেবল তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় চাকরি পান।
দক্ষিণ কোরিয়ার ২০ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন মোখলেসুর রহমান। তিনি বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য অবশ্যই ভালো দেশ। তবে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এখানে ভাষার ওপর বেশি জোর দেয়া হয়। ভাষার দখল না থাকলে কোরিয়াতে কাজ করা কঠিন। তাই শুরুতেই ভাষার ওপর জ্ঞান নিতে হয়। কত মানুষ দক্ষিণ কোরিয়াতে গেছেন : জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ডাটাবেসের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়াতে মোট ৪৫ হাজার ৩২৭ জন শ্রমিক গেছেন। আর শুধু গত অক্টোবর মাসে সেখানে মোট ৩ হাজার ৪৫৯ জন শ্রমিক কোরিয়ায় গেছে। এর মধ্যে ইপিএস সিস্টেম ও ইপিএস চালুর আগেও কোরিয়াতে মানুষ কাজে গেছে।
কোথায় প্রশিক্ষণ নিতে হয় : দক্ষিণ কোরিয়ায় কাজ করতে যাওয়ার আগের প্রথম শর্ত কোরিয়ান ভাষা শিখতে হবে। সেই কারণে রাজধানীতে কোরিয়ান ভাষার ওপর দক্ষতা বাড়ানোর প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে ভাষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সারাদেশে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো পরিচালিত মোট ৭০টি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।