সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী পাস ॥ আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণ মামলার জেরার সময় ভুক্তভোগীকে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলার জেরার সময় ভুক্তভোগীকে চরিত্র ও অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না এমন বিধান যুক্ত করে ব্রিটিশ আমলের সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। নতুন আইনে বিচার কাজে বিভিন্ন ডিজিটাল তথ্যকেও সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ রাখা হয়েছে।
এসব বিধান যুক্ত করে বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলেন। বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করেন স্পিকার।
বিএনপিসহ বিরোধী দলের বেশিরভাগ সদস্যই আইন পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রশংসা করেন। তবে এর কোনও কোনও ধারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন বিএনপি থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা।
এই সংশোধনী পাস হওয়ার ফলে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিল হবে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি যখন ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।
বিলে ক্রস এগজামিনেশন বা জেরার সময় প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলার ভিকটিমকে তার নৈতিক চরিত্র বা অতীত যৌন আরচণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে যদি আদালত মনে করে এই ধরনের প্রশ্ন করা প্রয়োজন, তাহলে আদালতের অনুমতি নিয়েই কেবল তা করা যাবে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই ঔপনিবেশিক আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ ছাড়া সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধন ও নতুন ধারা যুক্ত করে মামলার বিচারে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনেরও সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেউ যাতে ভুয়া বা জাল সাক্ষ্যপ্রমাণ ডিজিটাল মাধ্যমে হাজির করতে না পারে, আদালত যদি মনে করে যে, কোথাও আপত্তিজনক কিছু আছে অথবা কেউ যদি আপত্তি তোলে, তাহলে ওই সাক্ষ্য-প্রমাণের ফরেনসিক পরীক্ষা করা যাবে।
এই আইন পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপি থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘এই আইনের খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আইনটা কার হাতে থাকবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। দেখা যায়, সে আইনটি ব্যবহার করা হয় প্রতিপক্ষকে দমন করার কাজে। শুধু তাই নয়, এটি ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ফেসবুকারদের বিরুদ্ধে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ডেটা সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে, এটি মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিঘ্নিত করবে।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, সাক্ষ্য আইনে ডিজিটাল রেকর্ড সাক্ষ্য হিসেবে নেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে, তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। কারণ, এখন ‘ডিপ ফেক’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজনের ছবির জায়গায় আরেকজনের ছবি ব্যবহার করে ভিডিও তৈরি করা যায়।’
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমাদের দেশে দীর্ঘদিনে যে মামলার জট লেগে গেছে সেটা ছাড়ানো তো সম্ভব নয়। জেলা কোর্টগুলোতে গেলে মনে হবে হাটবাজার বসছে। মানুষের ভীড়। দেওয়ানি মামলা পিতা রুজু করলে সন্তানও তার রায় দেখে যেতে পারেন না। আইনমন্ত্রী ও ভূমি সচিবের সহায়তায় একটি মামলায় ৬৫ বছর পর আমরা এক লাখ মানুষ নিষ্কৃতি পেয়েছি।’ মামলার জট নিরসনে তিনি শালিসি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব করেন।
পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘গত ৩০ জুন পর্যন্ত আদালতে বিচারাধীন মামলা ৪১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৫৩টি। এই মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এই মামলা দ্রুততম সময় নিষ্পত্তিতে বিকল্প চিন্তা করা দরকার।’
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, ‘অপরাধীদের শাস্তির জন্য নানা আইন করেছি।’ যারা মিথ্যা তথ্য ও মিথ্য সাক্ষ্য দিয়ে মামলা দায়ের করছে, তাদের বিচারে দ্রুত বিচার আইন করার দাবি করেন তিনি। হারুনুর রশীদ বলেন, ‘বিরোধী দলের হাজার হাজার সদস্যের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করছে। তাদের এই মামলার কারণে আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। বিদেশে থাকার পরেও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে।’ দেশে আইনের শাসন বিদ্যমান কিনা মন্ত্রীর কাছে সেই প্রশ্ন রখে বিএনপির এই এমপি বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন না থাকলে যতই ভালো আইন করি না কেন, কাজে আসবে না।’
বিরোধীদের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এই আইনের একটি ধারা ছিল নারীদের জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক। তা সংশোধন করা হচ্ছে, যা নারীদের জন্য সম্মানজনক, দেশের জন্য সম্মানজনক।’
মিথ্যা অভিযোগে মামলার বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘মিথ্যা অভিযোগে মামলা হতে পারে। কিন্তু কেউ মিথ্যা অভিযোগে মামলা করলে আইনে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করারও সুযোগ আছে। এখন আইনের মাধ্যমেই দেশ চলছে।’
আলোচনা করে তথ্য সুরক্ষা আইন করা হবে
রুমিনের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘তথ্য সুরক্ষা আইন পাস করার আগে অংশীজনদের সঙ্গে আবার আলোচনা করা হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এই আইন করা হবে। কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নয়, নাগরিকের তথ্য যাতে সুরক্ষিত থাকে, সেজন্য এই আইন করা হচ্ছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বিরোধী দলকে টার্গেট করে এই আইন করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এটি করা হয়েছে। এই আইনের অপব্যবহার হয়েছে, তা তারা স্বীকার করে শোধরানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিএনপি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) পাস করেছিল। এরজন্য তারা কখনও দুঃখ প্রকাশও করেনি।’