কাজিরবাজার ডেস্ক :
জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। নতুন জঙ্গি সংগঠন। জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) প্রভৃতি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন থেকে সদস্য নিয়ে গঠিত জঙ্গিদের নতুন প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার হয়েছে সংগঠনটির বেশ কিছু সদস্য। ছদ্মবেশে সংগঠিত হচ্ছিল তারা। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনটিও নিষিদ্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জানা যায়, সংগঠনের কার্যক্রম, উদ্দেশ্য ও সদস্যসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে নথি যাওয়ার পরে নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দেশের প্রায় সব জঙ্গি সংগঠন সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে আগেই। ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম চালাতে নতুন প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিল। এ কারণেই নতুন নাম দিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল জঙ্গিরা।
এখন পর্যন্ত দেশে নিষিদ্ধ ৮ জঙ্গি সংগঠন
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্র ইসলামি সংগঠন হিসেবে আটটি সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়। সবশেষ ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয় জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দল’।
এর আগে ২০১৭ সালের ১ মার্চ জঙ্গি সংগঠন হিসেবে ‘আনসার আল ইসলাম’ নিষিদ্ধ করে সরকার। জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকায় এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহাদত-ই-আল হিকমা, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), ২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ও জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীর ও ২০১৫ সালের ২৫ মে আনসারুল্লাহ বাংলাকে টিম নিষিদ্ধ করা হয়।
২০১৫ সালের মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরাই সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারী বরখাস্ত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়ার নেতৃত্বে আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা চালিয়ে আসছিলেন। ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকেও সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
জানা যায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নেতৃত্বে রয়েছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বহিষ্কৃত শিক্ষক। যার নাম শামিন মাহফুজ ওরফে শামিন স্যার ওরফে মেন্ডিং মুরং। পলাতক শামিনকে গ্রেফতারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে দুবার গ্রেফতার হন শামিন। সবশেষ গ্রেফতার হন ২০১৪ সালে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ২০১৭ সালে জামিনে বের হওয়ার পর থেকেই লাপাত্তা। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন থেকে সদস্য এনে নতুন জঙ্গি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে শামিনের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
নতুন জঙ্গি দল গঠনের পরিকল্পনা হয় কারাগারে
কারাগারে থাকার সময়ই শামিনের সঙ্গে রক্সি এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হরকাতুল জিহাদ নেতা আবু সাঈদের পরিচয় হয়। সেখানেই তারা নতুন জঙ্গি দল গড়ার পরিকল্পনা করেন। ২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর রক্সি ও শামিন মাহফুজ মিলে সেই দল গঠনের কাজ শুরু করেন।
পাহাড়ে বাড়িছাড়া তরুণদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে উগ্রবাদী সংগঠন কেএনএফ
দুর্গম পাহাড়ে বাড়িছাড়া কিছু তরুণ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নতুন জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া অন্তত ৩৮ তরুণ বর্তমানে এই কেএনএফের অধীনে দুর্গম পাহাড়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থান তাদের হামলার টার্গেট হতে পারে- এমন গোয়েন্দা তথ্যের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও র্যাব যৌথ অভিযান পরিচালনা করছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তাদের বাছাই করা তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে সিনিয়র সদস্যের হেফাজতে রাখে। যেসব বাড়িতে রাখা হয়, সেটাকে তারা আনসার হাউজ (সাহায্যকারীর বাড়ি) বলে। এরপর চরাঞ্চলে শারীরিক কসরতসহ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানে কেএনএফ’র ক্যাম্পে পাঠানো হয়। কেএনএফ’র ক্যাম্পে এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে। সেখানে একে-৪৭ রাইফেল, পিস্তল ও কাটা বন্দুক চালানো, বোমা (আইইডি) তৈরি এবং চোরাগোপ্তা হামলার (অ্যাম্বুশ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
৬ অক্টোবর নতুন জঙ্গি সংগঠনের নাম জানায় র্যাব
গত ৫ অক্টোবর ঘরছাড়া সাত তরুণকে গ্রেফতারের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন- বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হুজির বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী একত্রিত হয়ে এই উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৭ সাল থেকে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে এই নতুন মঞ্চে ভেড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়। ২০১৯ সালে নতুন জঙ্গি সংগঠনের নাম দেওয়া হয় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। সম্প্রতি দেশের কুমিল্লা ও অন্য অঞ্চল থেকে বাড়ি ছেড়ে কথিত হিজরত করেন অর্ধশতাধিক যুবক। যাদের মোটিভেশন, প্রশিক্ষণসহ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেএমবি, নব্য জেএমবি, হিজবুত তাহরীরসহ অন্যান্য নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন থেকে আসা নেতৃস্থানীয়রা।
নতুন জঙ্গি সংগঠনের কর্মীকে প্রথমে গ্রেফতার করে সিটিটিসি
জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দাওয়া বিভাগের প্রধান সদ্য এমবিবিএস পাস করা শাকির বিন ওয়ালী নামে এক চিকিৎসককে গত ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে চিকিৎসক শাকির নতুন জঙ্গি সংগঠনের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। এরপর ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ডেমরা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি।
চিকিৎসক শাকির ঢাকা থেকে দুর্গম পাহাড়ে গিয়ে অসুস্থ ও আহত ঘরছাড়া তরুণদের চিকিৎসা দিতেন। এছাড়াও তিনি পাহাড়ি উগ্রবাদী সংগঠন কুকি-চিনের সদস্যদেরও চিকিৎসা দিতেন। প্রতি মাসে একবার করে যেতেন পাহাড়ে। আবার তিনি যখন ঢাকায় থাকতেন তখন নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রধান শামিন মাহফুজ ওরফে স্যারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতেন। ফোনে সদস্যদের অসুস্থতার লক্ষণ শুনে ব্যবস্থাপত্র পাঠাতেন শাকির।
নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রধান শামিন ও কুকি-চিনের প্রধান নাথান দুজন বন্ধু
শামিন মাহফুজ ২০০৬ সাল থেকে পাহাড়ি এলাকাকে কেন্দ্র করে একটি জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করে আসছিলেন। সবশেষ ২০১৭ সালে যখন তিনি জামিনে বের হন, তখন তিনি পাহাড়ি এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুঁজতে থাকেন। এরপর তিনি জানতে পারেন, পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন নামে একটি সংগঠন আছে। সেই সংগঠনের প্রধান হলেন নাথান বোম। নাথান বোম আবার শামিন মাহফুজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শামিন ও নাথান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন।
গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, পার্বত্য অঞ্চলকে প্রশিক্ষণ শিবির হিসেবে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হলো তাদের সদস্যদের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখা। পার্বত্য অঞ্চল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সমতল ভূমিতে এসে হামলা করে যেন নিরাপদে আবারও ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারেন।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দেশের কয়েকটি জেলা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের খোঁজ করতে গিয়ে সম্প্রতি আমরা জানতে পারি, তারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়িছাড়া হয়েছে। যারা অধিকাংশই নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যুক্ত। এই সংগঠনের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই আমরা। নিরুদ্দেশ হওয়া ৩৮ জনের অধিকাংশই পার্বত্য অঞ্চলের ভেতর অবস্থান করছেন। তারা সেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ছত্রচ্ছায়ায় আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
নিষিদ্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ সদরদপ্তর এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।
জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নিষিদ্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ-কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা পুলিশ সদরদপ্তরে সুপারিশ করবো এবং সেই সুপারিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। পরবর্তীসময়ে মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ করবে।