আতিকুর রহমান নগরী :
বন্ধুত্ব – একে অন্যের সুখে-খুশিতে লাফিয়ে ওঠার; একে অন্যের দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর। মন খুলে কথা বলা, হেসে গড়াগড়ি খাওয়া আর চূড়ান্ত পাগলামি করার একমাত্র আধার এ ‘বন্ধুত্ব’। বন্ধুত্ব কোনো বয়স মেনে হয় না, ছোট-বড় সবাই বন্ধু হতে পারে। তবে বন্ধুত্বের মধ্যে যে জিনিসটা অবশ্যই থাকা চাই তা হল ‘ভালোবাসা’।
বন্ধুত্বের এই ধারণা বা সংজ্ঞাটি হল, বিশ্ব মুক্তকোষ উইকিপিডিয়ার। তবে আমি মনে করি ব্যক্তি জীবনে বন্ধুর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বন্ধু মানে সুখদুখের সাথী। বন্ধু মানে শক্তি-সাহসের উৎস।
সঠিকভাবে যথার্থ বন্ধু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষ তার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের বিকাশ ঘটায়। এমন বন্ধুত্বের বিষয়ে রয়েছে ইসলামের বিশেষ নির্দেশনা। মানবতার ধর্ম ইসলাম মনে করে, ভালো বন্ধুত্বের প্রভাব অন্য বন্ধুর জীবনেও প্রতিফলিত হয়। বলা হয়েছে, ‘একাকী নিঃসঙ্গতার চেয়ে ভালো বন্ধু উত্তম আর নিঃসঙ্গতা মন্দ বন্ধুর চেয়ে উত্তম।’ তার মানে হলো, ভালো বন্ধু যদি নাও থাকে সেটা মন্দ ও অযোগ্য বন্ধু থাকার চেয়ে ভালো। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত। কারও প্রতি মন আকৃষ্ট হলেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে এমনটা ঠিক নয়। বরং প্রথমে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, তার প্রতি আকর্ষণের কারণ কিংবা উৎস কী; সে আদৌ বন্ধু হওয়ার যোগ্য কি না ইত্যাদি।
অভিজ্ঞ মুসলিম চিন্তাবিদদের অভিমত হলো, ‘যে ব্যক্তি চিন্তাভাবনা করে যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ করে বন্ধু নির্বাচন করবে, তাদের বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হবে।’ হঠাৎ করে কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অর্থাৎ কোনোরকম বাছ-বিচার ছাড়া বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে অনেক সময় দুঃখজনক পরিণতি ঘটতে পারে। ইন্টারনেটে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুব সহজেই অনুমান করা যায়। এখনকার সময়ে অনেকে বন্ধুত্বের পাল্লায় পরে মাদকাসক্ত হচ্ছে, কেউ জড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাসে। অনেক সময় খুন, ধর্ষণ ও ছিনতাইয়ের মতো কাজেও জড়িয়ে পড়ছে শুধু বন্ধুত্বের টানে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পবিত্র কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন-যাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী। -সূরা আত তওবা: ৭১
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসলো, তো আল্লাহর জন্যই ভালোবাসলো, কাউকে ঘৃণা করলো তো আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করলো, কাউকে কিছু দিলো তো আল্লাহর জন্যই দিল এবং কাউকে দেয়া বন্ধ করলো তো আল্লাহর জন্যই দেয়া বন্ধ করলো, তবে সে তার ঈমানকে পূর্ণ করলো। ’ মিশকাত শরিফ
বন্ধু নির্বাচনে সব সময় এমন মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যে কল্যাণের পথ দেখাবে। এবং অকল্যাণের পথ থেকে বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। পক্ষান্তরে এমন লোকদের বন্ধু তালিকা থেকে দূরে রাখা উচিত, যারা বন্ধুকে অকল্যাণের পথে ঠেলে দেবে। তাঁর দুনিয়া-আখিরাত ধ্বংসের কারণ হবে। কারণ আত্মার সঙ্গে আত্মার বন্ধুত্ব কল্যাণকর; কিন্তু প্রেতাত্মার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ভয়ংকর। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৩৩)
যেহেতু বন্ধুত্ব ও বন্ধুদের আচার-আচারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই যে বন্ধু সর্বদা আল্লাহর কথা স্মরণ করাবে, কখনো বিপথগামী হতে গেলে সে তার বন্ধুকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সতর্ক করবে, সে ধরনের বন্ধু নির্বাচন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আবু মুসা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ মিসক বিক্রেতা ও কর্মকারের হাঁপরের মতো। আতর বিক্রেতাদের থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসবে না। হয় তুমি আতর খরিদ করবে, না হয় তার সুঘ্রাণ পাবে। আর কর্মকারের হাঁপর হয় তোমার ঘর অথবা তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে, না হয় তুমি তার দুর্গন্ধ পাবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ২১০১)। বন্ধু নির্বাচনে কোন ধরনের মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সে ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট নির্দেশনা অনুসরণ করা উচিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মুমিন পুরুষ এবং মুমিনা নারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন-যাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী। ’ (সূরা : আত তওবা, আয়াত : ৭১)
যারা মহান আল্লাহর দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী বন্ধু নির্বাচন করবে না এবং বন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঈমানহারা হবে, কিয়ামতের দিন তাদের আপসোসের সীমা থাকবে না। কিন্তু সেদিন তাদের কিছুই করার থাকবে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘জালিম ব্যক্তি সেদিন নিজের দুহাত কামড়াতে কামড়াতে বলবে, হায়, আমি যদি রাসুলের সঙ্গে সৎপথ অবলম্বন করতাম। হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার কাছে উপদেশ পৌঁছার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।’ (সূরা : ফুরকান, আয়াত : ২৭-২৯)
ন্ধুত্বের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যক্তিগত অহমিকা বা গর্ব পরিহার করা। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যখন গভীর হয় তখন এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাছ থেকে কেবল যে সম্মানই পায় তা-ই নয় বরং নিজেকে কেউ বড়ো করে দেখারও চেষ্টা করে না, অহংকারও করে বেড়ায় না।
লেখক: সাংবাদিক, আলেম।